শেয়ারবাজারে ৪৮ দিনে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি ১ লাখ কোটি টাকা
টানা দরপতনে মাত্র ৪৮ কার্যদিবসে দেশের প্রধান শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদেরই ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত ১৮ জানুয়ারি থেকে গতকাল ১ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের বাজারমূল্যের হিসাব বিবেচনায় নিয়ে এ ক্ষতির হিসাব পাওয়া গেছে। এ সময়ে ঢাকার শেয়ারবাজারে লেনদেন হয়েছে মোট ৪৮ দিন।
তালিকাভুক্ত কোম্পানি, বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে প্রতিদিন বাজার মূলধনের হিসাব করে ডিএসই। ডিএসইর হিসাবে গত ১৮ জানুয়ারি বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। গতকাল সোমবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪৮ দিনে তালিকাভুক্ত সব সিকিউরিটিজ ১ লাখ ১০ হাজার ২৩১ কোটি টাকা বাজারমূল্য হারিয়েছে। তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যক্তিশ্রেণি থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তারাও। কারণ, সিকিউরিটিজের দাম কমে যাওয়ায় তাঁদের প্রত্যেকেরই পোর্টফোলিও বা পত্রকোষ সংকুচিত হয়েছে। এর মধ্যে যাঁরা শেয়ার বা অন্যান্য সিকিউরিটিজ বিক্রি করে দিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সরাসরি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আর যাঁরা বিক্রি করেননি, তাঁদের ক্ষেত্রে এ ক্ষতি অনাদায়ি (আনরিয়ালাইজড) হিসেবে পত্রকোষে হিসাবভুক্ত হয়েছে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানি, বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে প্রতিদিন বাজার মূলধনের হিসাব করে ডিএসই। ডিএসইর হিসাবে গত ১৮ জানুয়ারি বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। গতকাল সোমবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা।
হতাশ বিনিয়োগকারীরা
শেয়ারবাজারের টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম হতাশা লক্ষ করা গেছে। বাজারের এ পতন শুরু হয়েছে শেয়ারের দামের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর থেকে। গত ২১ জানুয়ারি থেকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কয়েক ধাপে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়। এরপর কিছুদিন বাজারে শেয়ারের দাম বাড়লেও ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মোটামুটি একটানা দরপতন শুরু হয়।
শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতেই ২০২২ সালের জুলাই থেকে সর্বশেষ দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা হয়েছিল। এর মাধ্যমেই দেড় বছরের বেশি সময় কৃত্রিমভাবে বাজারকে একটি সীমার মধ্যে ধরে রেখেছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস উঠে যাওয়ার পর বাজার আর বেঁধে রাখা যায়নি। থেমে থেমে দরপতন চলছেই। গতকালও বড় দরপতন হয়েছে বাজারে। এদিন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৬৮ পয়েন্ট বা ১ শতাংশের বেশি কমে ৫ হাজার ৭৬১টি পয়েন্টে নেমে এসেছে। প্রায় তিন বছরের মধ্যে এটিই ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ ২০২১ সালের ১২ মে এ সূচক ৫ হাজার ৭৫০ পয়েন্টে ছিল।
বাজারকে আমরা বাজারের গতিতেই চলতে দিতে চাই। বাজার যে পর্যায়ে নেমেছে, তাতে আশা করছি শিগগিরই নিজস্ব শক্তিতেই বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।মোহাম্মদ রেজাউল করিম, নির্বাহী পরিচালক, বিএসইসি
ঢাকার বাজারের মতো বড় দরপতন হয়েছে অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)। সিএসইর সার্বিক সূচকটি গতকাল ১১৭ পয়েন্ট বা পৌনে ১ শতাংশ কমেছে। দুই বাজারেই এদিন দরপতন হয়েছে লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের। ডিএসইতে লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৭৯ শতাংশের দরপতন হয়েছে। দাম বেড়েছে মাত্র ১২ শতাংশের। আর অপরিবর্তিত ছিল ৯ শতাংশের দাম। চট্টগ্রামের বাজারে লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৬৩ শতাংশের দরপতন হয়েছে। দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশের। আর অপরিবর্তিত ছিল ৮ শতাংশের দাম।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি থেকে ১ এপ্রিল—এ তিন মাসে শেয়ারবাজারে লেনদেন হয়েছে মোট ৬১ দিন। এর মধ্যে ৩২ দিনই সূচকের পতন হয়েছে। আর সূচক বেড়েছে ২৯ দিন। বাজারে খবর নিয়ে দেখা গেছে, টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা ভয়ে শেয়ারবাজার ছেড়ে দিচ্ছেন। আরও দরপতন হতে পারে, এ ভয়ে লোকসানেও শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ।
১০ দিনে ৩৪ হাজার বিও হিসাব খালি
বিনিয়োগকারীরা যে শেয়ারবাজার ছেড়ে যাচ্ছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের তথ্যেও। প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার ধারণের তথ্য সংরক্ষণ করে। সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ মার্চ শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৯। গতকাল দিন শেষে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯২–এ। অর্থাৎ ১০ কার্যদিবসের ব্যবধানে ৩৩ হাজার ৮৪৩ জন বিনিয়োগকারী তাঁদের বিও হিসাবে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
যে হারে বিনিয়োগকারীরা সব শেয়ার বিক্রি করে নিষ্ক্রিয় হয়েছেন, সে হারে নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসছেন না। সিডিবিএলের হিসাবে, গত ১০ কার্যদিবসে যেখানে প্রায় ৩৪ হাজার বিও হিসাব খালি হয়েছে, তার বিপরীতে নতুন হিসাব খোলা হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩০৬টি। ফলে শেয়ার আছে, এমন বিও হিসাবের সংখ্যা কমে গতকাল দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৫৮ হাজার ২১১–তে। গত ১৮ মার্চ এ সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৮৩০।
কেন দরপতন
বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফ্লোর প্রাইস দিয়ে বাজারকে দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ধরে রেখে যে ক্ষতি করা হয়েছে, তারই ফলাফল এখনকার এ দরপতন। ফ্লোর প্রাইস যে দীর্ঘ মেয়াদে বাজারের জন্য নানামুখী সংকট তৈরি করেছে, তা এখন পরিষ্কার হয়েছে। একদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন, অন্যদিকে দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে নগদ টাকার যে সংকট রয়েছে, তাতে সেখান থেকে শেয়ারবাজারে খুব বেশি অর্থ আসার সুযোগ নেই। এসব কারণে বাজারে টানা দরপতন চলছে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইসের কারণে আমাদের বাজার নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার চরম ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যে লভ্যাংশ ঘোষণা করছে, ডলার–সংকটের কারণে তার বড় অংশই তারা বিদেশি মালিকদের কাছে পাঠাতে পারছে না। আবার ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিদেশিরা কম মুনাফা পাচ্ছেন। এসব কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।’
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, ব্যাংকে এখন আমানতের ওপর যে সুদ পাওয়া যাচ্ছে, তা শেয়ারবাজারের মূলধনি মুনাফার চেয়ে বেশি। তাই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
টেনে তোলার চেষ্টা ব্যর্থ
কয়েক দিন চেষ্টা করে পতন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এখন বাজারকে আর টেনে তোলার চেষ্টা করছে না। বরং বাজারকে বাজারের নিয়মেই চলতে দেওয়ার পথে হাঁটছে তারা। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত সপ্তাহের শুরুতেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের ফোন করে শেয়ারের বিক্রি কমিয়ে পতন ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক দিন ধরে সেই চেষ্টা আর করা হয়নি।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারকে আমরা বাজারের গতিতেই চলতে দিতে চাই। বাজার যে পর্যায়ে নেমেছে, তাতে আশা করছি শিগগিরই নিজস্ব শক্তিতেই বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ, ভালো অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম অবমূল্যায়িত পর্যায়ে নেমে গেছে। কৃত্রিমভাবে বাজারকে টেনে তোলার বদলে আমরা এখন তদারকি বা সার্ভেইল্যান্স ব্যবস্থা জোরদার করেছি। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে দরপতনের চেষ্টা করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, একদিকে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দরপতন হচ্ছে, অন্যদিকে কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হচ্ছে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম। এটিও বাজারের প্রতি ভালো বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। বছরের পর বছর কিছু খারাপ কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেগুলোর বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপই নেয়নি।
খারাপ শেয়ারের দাম বাড়ছেই
ঢাকার বাজারে গতকাল মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল মার্কেন্টাইল ইনস্যুরেন্স, ম্যাকসন্স স্পিনিং, আইটি কনসালট্যান্টস, ই-জেনারেশন, শাইনপুকুর সিরামিকস, কে অ্যান্ড কিউ, ফার কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, দেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্সের মতো কোম্পানি। এসব কোম্পানির কোনো কোনোটি গত কয়েক বছরে বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিতে পারেনি। তবু মূল্যবৃদ্ধিতে এসব কোম্পানি এগিয়ে রয়েছে। এর বিপরীতে দরপতন হয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ব্র্যাক ব্যাংক, বেক্সিমকো ফার্মা, গ্রামীণফোন, রেনেটা, বার্জার পেইন্টস, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন হাউজিংসহ ভালো লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানির শেয়ারের।