সংকট ছড়িয়েছে শেয়ারবাজারেও
মুদ্রাবাজার ও পণ্যবাজারের অস্থিরতা এখন ছড়িয়েছে শেয়ারবাজারেও। কারণ, এ বাজারে বিনিয়োগ যাঁরা করবেন, তাঁরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। সাধারণ মানুষ যাঁরা বাড়তি আয়ের আশায় শেয়ারবাজারে কিছু বিনিয়োগ করেন, তাঁরা জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও রয়েছেন অর্থের সংকটে। আর অল্প কিছু যে বিদেশি বিনিয়োগ এ দেশের শেয়ারবাজারে রয়েছে, তাঁরাও ডলারের দামের অস্থিরতায় শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ অবস্থায় গতকাল বাজারে বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। এ দরপতনে বড় সংকট ছিল ক্রেতার।
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৩৪ পয়েন্ট বা ২ শতাংশ কমেছে। এতে প্রধান সূচকটি আবারও সাড়ে ৬ হাজার পয়েন্টের মাইলফলকের নিচে নেমে এসেছে। এর আগে সর্বশেষ গত ৭ মার্চ সর্বোচ্চ ডিএসইএক্স সূচকটি ১৮২ পয়েন্ট বা পৌনে ৩ শতাংশ কমেছিল। গতকালের বাজারে লেনদেন হওয়া ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেরই শেয়ারের দরপতন হয়েছে। এদিন ৩৮১টি প্রতিষ্ঠানের লেনদেন হয়। যার মধ্যে ৩৪৮টির দাম কমেছে, বেড়েছে মাত্র ২৬টির আর অপরিবর্তিত ছিল ৭টির দাম। যেসব প্রতিষ্ঠানের দাম কমেছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ারের ক্রেতাসংকট ছিল। ফলে এসব শেয়ার দিনের সর্বনিম্ন দামে নেমে আসে। তা–ও ক্রেতা ছিল খুবই কম। সে জন্য এসব শেয়ারের হাতবদল হয়েছে কম।
কেন পতন
বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের আগে থেকেই বাজারে বেশ মন্দাভাব বিরাজ করছে। ঈদের পরে কয়েক দিন বাজারে কিছুটা লেনদেন বেড়েছিল। এ অবস্থায় গত দুদিন আবার বাজার পতনের ধারায় ফিরে যায়, যার প্রধান কারণ ছিল মুদ্রাবাজার ও পণ্যবাজারের অস্থিরতা। সামগ্রিক অবস্থার কারণে বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ কমে গেছে। ব্যাংকগুলো এখন ডলারের চাপ সামাল দিতে প্রতিদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ অর্থের বিনিময়ে ডলার কিনছে। অন্যদিকে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন। অর্থনীতি নানাভাবে চাপের মুখে পড়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও বাজারের ওপর আস্থা হারিয়েছেন, যার ফলে বাজারে বড় পতন দেখা দিয়েছে।
দেশের শেয়ারবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই ব্যাংক। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন বা আইসিবিসহ কিছু মিউচুয়াল ফান্ড প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর ভূমিকা পালন করে। এর বাইরে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগ। যাঁদের মধ্যে আবার বড়, মাঝারি ও ছোট বিভিন্ন শ্রেণির বিনিয়োগকারী রয়েছেন। এ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের একটি বড় অংশ আসে শেয়ারের বিপরীতে মার্জিন ঋণ বা প্রান্তিক ঋণ থেকে। শেয়ারবাজারে দরপতন হলে ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের ঋণ নেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়।
সাধারণত বৈশ্বিক বা অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কোনো সংকট দেখা দিলে শেয়ারবাজারে তার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে। কারণ, সংকটের আভাস পেলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বা আয় বাড়লেও মুনাফা সে হারে বাড়ছে না। বাড়তি আয় খেয়ে ফেলছে কাঁচামাল আমদানির বাড়তি দাম। ফলে মুনাফার বড় ধরনের কোনো ইতিবাচক কোনো আশা আপাতত নেই। এ কারণে যাঁরা চতুর বিনিয়োগকারী, তাঁরা আগে থেকেই পর্যালোচনা করে শেয়ার বিক্রি করে টাকা হাতে রেখে দেন। দাম যখন অনেক কমে যায়, তখন তাঁরা আবার শেয়ার কেনেন।
বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ সক্ষমতা কিছুটা কমেছে। পাশাপাশি ডলার নিয়ে অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এর প্রভাব বাজারে আছে ঠিকই। কিন্তু বাজারের বড় পতনের জন্য এসবই একমাত্র কারণ নয়।
বরং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের আশা জাগিয়ে বাজারকে যেভাবে ওপরে তোলা হয়েছিল, সে অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আসেনি। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে বাজারে। কারণ, কৃত্রিমভাবে কোনো কিছু করলে সেটি স্থায়ী হয় না।
তবে গতকাল বাজারে যে দরপতন হয়েছে, সেটিকে ‘প্যানিক সেল বা ভয় থেকে বিক্রি’জনিত পতন বলছেন বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেকে। তাঁরা বলছেন, মুদ্রাবাজার ও পণ্যবাজারে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কিছু আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। এর মধ্যে আরেকটি খবরও গতকালের বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তবে তাঁরা এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে রাজি হননি। সেই খবর হচ্ছে আইসিবির কাছে রাখা কয়েকটি ব্যাংক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের মেয়াদ পূর্তি। এসব আমানত ফেরত দিতে হলে আইসিবিকে শেয়ার বিক্রি করতে হবে। আর সেটি হলে একদিকে যেমন আইসিবির ক্রয়ক্ষমতা কমবে, অন্যদিকে বিক্রির চাপ বাড়বে। তাই এমন খবর বাজারের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
কী করছে বিএসইসি
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) বাজারে দরপতন নিয়ে উদ্বিগ্ন। পতন ঠেকানোর চেষ্টায় আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আইসিবিতে রাখা ব্যাংক ও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ পূর্তি হয়ে যাওয়া আমানতের আসল অর্থ যাতে এখনই ফেরত না দিয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। গতকাল আইসিবির পক্ষ থেকেও ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমানতের মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘শেয়ার বিক্রি করে যাতে এখনই আইসিবিকে মেয়াদ পূর্তির আমানতের অর্থ ফেরত দিতে না হয়, আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে সেই চেষ্টা করছি। প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে, যাতে আমানতের মেয়াদ বাড়ানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়কেও আমরা বিষয়টি অবহিত করেছি।’
করণীয় কী
একাধিক মার্চেন্ট ব্যাংকার ও ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী বলেছেন, অর্থনীতি খারাপ হলে তার কিছু প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়বে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে জন্য বাছবিচার ছাড়া সব শেয়ারের দাম কমার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। তাই বাজারের সব শেয়ারের পতন থামাতে হলে প্রথম দরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখা।
পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও যাতে বাজারে সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের বিনিয়োগ বাড়ায়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা যাতে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে না পারে, সে জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এখানেই বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। মুদ্রাবাজারের সংকট মোকাবিলায় সরকারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, তা পরিষ্কার করে কেউ জানতে পারছে না। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা বাড়ছে।
তবে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীর পরামর্শ হলো, বাজারকে তার নিয়মে চলতে দেওয়া। কৃত্রিম কোনো প্রত্যাশা তৈরি না করে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া। সেই সঙ্গে বাজারের কারসাজি রোধে কঠোর হওয়া।