প্রথম আলো এক্সপ্লেইনার
ইতিহাসের ভয়ংকর ট্যারিফ যুদ্ধে কে জিতবে, কে হারবে
যুদ্ধ শুরু করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এতে জড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সব দেশ। ফলে যুদ্ধ এখন ভয়ংকর রূপ নেওয়া শুরু করেছে। জেনে নিই এই যুদ্ধের আদ্যোপান্ত।
শেষ ট্যারিফ যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৩০ সালে। এবারের ট্যারিফ যুদ্ধ তার চেয়েও ভয়াবহ চেহারা নিতে শুরু করেছে। এর পরিণতি কী হবে, কেউ জানে না। চরম অনিশ্চয়তায় সারা বিশ্ব।
বাণিজ্য ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্যারিফ যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৩০ সালে। সেই যুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর ঠিক ৮০ বছর পরে আবার সেই ট্যারিফ যুদ্ধ শুরু করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছিলেন ট্রাম্প। তবে সেই যুদ্ধ সীমাবদ্ধ ছিল মূলত চীনের সঙ্গে। চীনের সঙ্গে বিশাল বাণিজ্য–ঘাটতি কমাতে ২০১৮ সালে ট্রাম্প চীনের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন। চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। তখনই ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন।
জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত বাতিল করেননি। তবে তিনি গণহারে ব্যবস্থা না নিয়ে লক্ষ্যভিত্তিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট হয়ে অন্য কিছুর আর ধার ধারেননি। বরং গণহারে ট্যারিফ বা শুল্ক আরোপ করেছেন। আর তাতেই বিশ্ববাণিজ্য তোলপাড়।
সময়রেখা: যেভাবে ট্যারিফ যুদ্ধ শুরু
২০ জানুয়ারি
শপথ নিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। উদ্বোধনী ভাষণে ট্রাম্প আবারও প্রতিশ্রুতি দেন যে নিজ দেশের নাগরিকদের সমৃদ্ধির জন্য বিদেশি রাষ্ট্রের ওপর শুল্ক ও কর বসাবেন। তিনি আরও জানান, এ জন্য এক্সটারনাল রেভিনিউ সার্ভিস নামে একটি পৃথক এজেন্সি তৈরি করবেন।
দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দিনেই ট্রাম্প জানান, তিনি কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বা ট্যারিফ বসাবেন, যা কার্যকর হবে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। যদিও এ সময় তিনি চীনের পণ্য আমদানির ওপর কর বসানোর পরিকল্পনার কথা জানাতে রাজি হননি।
২৬ জানুয়ারি
ট্রাম্প কলম্বিয়ার সব ধরনের আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ এবং অন্যান্য প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো অভিবাসী বহনকারী দুটি মার্কিন সেনা উড়োজাহাজ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর ট্রাম্প এই হুমকি দেন। কলম্বিয়ার অভিযোগ, ট্রাম্প অভিবাসীদের ফেরত দেওয়ার সময় মর্যাদাপূর্ণ ব্যবহার করেননি।
এর প্রতিক্রিয়ায় কলম্বিয়া মার্কিন পণ্যের ওপর পাল্টা ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। তবে দেশটি পরে এই ঘোষণা থেকে সরে আসে এবং অভিবাসীদের গ্রহণ করে।
১ ফেব্রুয়ারি
ট্রাম্প মেক্সিকো, কানাডা ও চীনের ওপর ট্যারিফ আরোপসংক্রান্ত এক নির্বাহী আদেশে সই করেন। এই আদেশ অনুযায়ী, চীনের সব পণ্য আমদানির ওপর ১০ শতাংশ এবং কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, যা ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।
তিনটি দেশই এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় এবং পাল্টা ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়ে দেয়।
৩ ফেব্রুয়ারি
মেক্সিকো ও কানাডার ওপর শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা ৩০ দিন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য ট্রাম্প সম্মত হন। কেননা, দেশ দুটি সীমান্ত নিরাপত্তা ও মাদক চোরাচালানের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের উদ্বেগ নিয়ে পদক্ষেপ নেবে বলে ঘোষণা দেয়।
৪ ফেব্রুয়ারি
চীনের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ কার্যকর করা হয়। চীনও একই দিনে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানায়। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ এবং গুগলের বিরুদ্ধে অ্যান্টি-মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসা করার বিষয়ে তদন্ত শুরু।
চীন যুক্তরাষ্ট্রের কয়লা ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস–পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেল, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বৃহৎ ইঞ্জিনের গাড়ির ১০ শতাংশ শুল্ক বসানোর ঘোষণা দেয়, যা কার্যকর হবে ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে।
১০ ফেব্রুয়ারি
ট্রাম্প ১২ মার্চ থেকে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানান। ২০১৮ সালে তিনিই ইস্পাতের ওপর শুল্কছাড় দিয়েছিলেন। নতুন পরিকল্পনার অর্থ হচ্ছে এখন ইস্পাত আমদানির ওপর ন্যূনতম ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। ২০১৮ সালে তাঁরই আমলে অ্যালুমিনিয়ামের শুল্ক ছিল ১০ শতাংশ, নতুন হার হবে ২৫ শতাংশ।
ফেব্রুয়ারি ১৩
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাল্টা বা রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ আরোপের পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি জানান, অন্য দেশ যে হারে শুল্ক আরোপ করে, ন্যায্যতার কারণে তিনিও তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শুল্ক আরোপ করবেন। তিনি এ সময় আরও জানান, চীন, মেক্সিকো বা কানাডা ছাড়াও ভারত বা ইউরোপ এই পাল্টা করের হাত থেকে রেহাই পাবে না। অর্থনীতিবিদেরা তখনই সাবধান করে দেন যে এর ফলে বিশ্ববাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
২৫ ফেব্রুয়ারি
ট্রাম্প আরেকটি নির্বাহী আদেশে সই করে বাণিজ্য বিভাগকে নির্দেশ দেন যে জাতীয় নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য আমদানি করা তামা বা কপারের ওপর শুল্ক থাকবে কি না, তা পর্যালোচনা করে দেখা। তিনি এ সময় জানান, এই উপকরণ মার্কিন প্রতিরক্ষা, অবকাঠামো এবং উদীয়মান প্রযুক্তিতে ব্যবহার বেশি হয়।
৪ মার্চ
কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ কার্যকর। তবে তিনি কানাডার জ্বালানি আমদানির ওপর শুল্কের হার ১০ শতাংশে সীমিত করেন। একই সঙ্গে ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করেন।
এই তিন দেশই পাল্টা শুল্ক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান। এর মধ্যে চীন ব্যাপক ভিত্তিতে মার্কিন পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, যা ১০ মার্চ থেকে কার্যকর হবে। একই সঙ্গে দুই ডজন মার্কিন কোম্পানির ওপর নানা ধরনের রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
৫ মার্চ
ট্রাম্প দেশটির গাড়ি নির্মাতাদের জন্য কানাডা ও মেক্সিকো থেকে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক এক মাসের জন্য ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনুমোদন দেন। এর আগে তিনি তিন বড় গাড়ি নির্মাতা বা ‘বিগ থ্রি’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এই বিগ থ্রি হচ্ছে ফোর্ড, জেনারেল মোটরস এবং স্টেলানটিস।
৬ মার্চ
ট্রাম্প আরও বড় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মেক্সিকোর বেশিসংখ্যক পণ্য এবং কানাডার কিছু পণ্যের আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ স্থগিত করেন। তবে ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হবে বলে জানিয়ে দেন।
১০ মার্চ
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কৃষি ও প্রাণিজ পণ্যের ওপর চীনের ১৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ব্যবস্থা কার্যকর। পণ্যের মধ্যে রয়েছে মুরগি, শূকর, সয়াবিন, গরুর মাংস, ইত্যাদি।
১২ মার্চ
ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা কার্যকর।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে দেয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের ২৬ বিলিয়ন ইউরো (২৮ বিলিয়ন ডলার) সমমূল্যের পণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। পণ্যের মধ্যে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ছাড়াও থাকবে টেক্সটাইল, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, কৃষিপণ্য, মোটরসাইকেল, বিস্কুট, পিনাট বাটার, জিনস, ইত্যাদি। পরে ২৭ সদস্যের এই জোট জানায়, মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা স্থগিত থাকবে।
কানাডা জানায়, তারাও ২৯ দশমিক ৮ কানাডীয় ডলারের (২০.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) সমপরিমাণ মূল্যের মার্কিন পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করেছে, যা ১৩ মার্চ থেকে কার্যকর হবে।
১৩ মার্চ
ট্রাম্প হুমকি যেন যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যদি যুক্তরাষ্ট্রের হুইস্কির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসায়, তাহলে ইউরোপের ওয়াইন, শ্যাম্পেন ও স্পিরিটের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
১৪ মার্চ
ট্রাম্প জানান, যে দেশ ভেনেজুয়েলা থেকে তেল বা গ্যাস কিনবে, তাদের ওপরেই ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এর পাশাপাশি তিনি ভেনেজুয়েলার ওপর নতুন শুল্ক আরোপেরও ঘোষণা দেন, যা ২ এপ্রিল থেকে শুরু হবে। উল্লেখ্য, চীন ৬৮ শতাংশ তেল ভেনেজুয়েলা থেকে আমদানি করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও ভেনেজুয়েলা থেকে তেল আমদানি করে।
২৬ মার্চ
ট্রাম্প জানান, তিনি মোটরগাড়ি আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসাতে ইচ্ছুক। সম্পূর্ণ গাড়ির ওপর এই শুল্ক আরোপ শুরু হবে ৩ এপ্রিল থেকে আর গাড়ির যন্ত্রাংশের ওপর শুল্ক কার্যকর হবে ৩ মে থেকে।
২ এপ্রিল
ট্রাম্পের বহুল আলোচিত পাল্টা শুল্ক আরোপ। সব দেশের জন্যই ১০ শতাংশ হারে শুল্ক ধার্য। এর বাইরে যাদের সঙ্গে বাণিজ্য–উদ্বৃত্ত বেশি, তাদের জন্য বাড়তি শুল্ক আরোপ। এ রকম দেশ ও অঞ্চলের সংখ্যা ৬০। এর মধ্যে চীনের ওপর আরোপ করা হয় ৩৪ শতাংশ শুল্ক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওপর ২০ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, জাপানের ওপর ২৪ শতাংশ, তাইওয়ানের ওপর ৩২ শতাংশ।
৩ এপ্রিল
ট্রাম্পের আগের ঘোষণা অনুযায়ী, অটোমোবাইল বা মোটরগাড়ির শুল্ক কার্যকর। কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি জানান, কানাডাও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে।
৪ এপ্রিল
চীন জানায়, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের পণ্যের ওপর পাল্টা ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে, যা কার্যকর হবে ১০ এপ্রিল থেকে। চীন আরও জানায়, তারা বিরল মৌল রপ্তানির ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। এই বিরল মৌল কম্পিউটার চিপস ও ইলেকট্রিক ভেহিকেলের ব্যাটারি তৈরিকে ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে চীন যুক্তরাষ্ট্রের ২৭টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করেছে, যাদের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হবে।
জে পি মর্গান জানায়, এ বছর মার্কিন অর্থনীতি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। এমনকি বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। ট্রাম্পের ঘোষণার আগে তারা বলেছিল ১.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
৫ এপ্রিল
ভিয়েতনামের শীর্ষ নেতা টো ল্যাম ট্রাম্পকে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত অন্তত ৪৫ দিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছেন। ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। টো ল্যাম হচ্ছেন প্রথম নেতা, যিনি ট্রাম্পের কাছে শুল্ক বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন।
৬ এপ্রিল
বিলিয়নিয়ার ফান্ড ম্যানেজার বিল অকম্যান, যিনি নির্বাচনের সময় ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছিলেন, এক্স হ্যান্ডলে বলেছেন, ট্রাম্প ব্যবসায়ী নেতাদের আস্থা হারাচ্ছেন। এখন ট্রাম্পের উচিত বাণিজ্যযুদ্ধ আপাতত স্থগিত করা। তিনি আরও বলেন, আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্যসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য বিরতি নিতে পারেন।
চীন মার্কিন পণ্যের ওপর পাল্টা ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নির্মাণ ও কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরে পতন ঘটেছে। যেমন ক্যাটারপিলারের দর কমেছে ৬ শতাংশ, ডিরির দর কমেছে ২.৯ শতাংশ, সিএনএইচের ৪.৪ শতাংশ ও এজিসিওর শেয়ারের দর কমেছে ৫ শতাংশ।
জেপি মর্গানের সিইও জেমি ডিমন বলেছেন, শুল্ক আরোপের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শ্লথ হবে ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সব মিলিয়ে এর প্রভাব নেতিবাচক হবে। গত সপ্তাহে শেয়ারধারীদের একটি চিঠি লিখেছেন তিনি, যা গত সোমবার প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি দ্রুত এর সমাধান চেয়েছেন।
সোমবার শেয়ার সূচক এস অ্যন্ড পি ৫০০-এর পতন হয়েছে ২০ শতাংশ, যা তাদের জন্য রেকর্ড। ইতিহাসে কখনো এতটা পতন ঘটেনি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সোমবারই ট্রাম্প মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেডকে নীতি সুদহার কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
হংকং সোমবার বলেছে, সরকার দেশটির ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে টিকে থাকতে সহায়তা দেবে।
ব্রেন্ট অয়েল বা অপরিশোধিত তেলের দাম ৩.২ শতাংশ কমে গেছে ৬৩.৪৯ ডলার, যা ২০২১ সালের এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন।
৭ এপ্রিল
এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ারবাজারে বড় পতন। হংকং এর হাং সেং সূচক কমেছে ১৩.২২ শতাংশ, যা গত ২৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, তাইওয়ানের শেয়ারবাজারের (তাইপেইজ তাইএক্স) সূচক কমেছে ৯.৭ শতাংশ। বাজার চালুর শুরুতেই যুক্তরাজ্যের এফটিএসই সূচক ৬ শতাংশ কমে গেলেও পরে কিছুটা উদ্ধার হয়ে পতন ৪ শতাংশের দাঁড়িয়েছে। জার্মানির শেয়ারবাজারের পতন ঘটেছে ১০ শতাংশ।
অ্যান্ড্রু হল, একজন বিলিয়নিয়ার অয়েল ট্রেডার। তিনি ইনস্টাগ্রামে এক পোস্ট দিয়ে বলেছেন, ‘আমি বিল অকম্যানের ভক্ত নই।’ তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ট্যারিফ আরোপ স্থগিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থাৎ অন্তত একজনকে পাওয়া গেল, যিনি নিজেকে শুধরে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং নিজের বোকামি থেকে বের হতে চেয়েছে। তাহলে অন্য সব ফিন্যান্সিয়াল টাইটানস-এ কই। তারা কেন কথা বলছেন না। প্রসঙ্গত, বিলিয়নিয়ার ফান্ড ম্যানেজার বিল অকম্যান নির্বাচনের সময় ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
জার্মানির অর্থনৈতিক বা ইকোনমিক মিনিস্টার রবার্ট হাবেক সব ইউরোপীয় অংশীদারকে একজোট হয়ে মার্কিন শুল্কনীতির বিরুদ্ধে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পাল্টা শুল্কহারের হিসাব করেছে, তা তাঁর ভাষায় ‘ননসেন্স’।
শেষ পর্যন্ত কিছুটা নমনীয় হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনা করতে চায়। এমনকি শিল্পপণ্যে শুল্কহার শূন্য করতেও রাজি, যদি যুক্তরাষ্ট্রও শূন্য করে। তবে তারা বলেছে, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, একই সঙ্গে বিশ্ববাণিজ্যে এর প্রভাব পড়বে অনেক বেশি।
হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। হোয়াইট হাউস থেকে বলা হলো এটাই প্রথম ট্যারিফ নিয়ে ট্রাম্প কোনো দেশের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি বৈঠক করলেন।
সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫০টি বেশি দেশ আরোপ করা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে।
৮ এপ্রিল
ট্রাম্প চীনকে আবার হুমকি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরোপ করা শুল্ক প্রত্যাহার না করলে চীনের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হবে। চীন এর জবাবে বলেছে, তারা লড়াই চালিয়ে যাবে। এর জবাবে চীনের শুল্কহার আবারও বৃদ্ধি করেছেন ট্রাম্প। ফলে চীনের শুল্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪ শতাংশ।
যেসব দেশ শুল্ক পরিহার করতে আলোচনার কথা বলেছে, তাদের নিয়ে মশকরা করেন ট্রাম্প। ন্যাশনাল রিপাবলিকান কংগ্রেশনাল কমিটির নৈশভোজ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘এসব দেশ আমাকে ডাকছে, আমাকে তোষামোদ করছে, আমার সঙ্গে একটি ডিল করার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে।’
৯ এপ্রিল
অবশেষে ট্রাম্পের শুল্কহার কার্যকর। বিশ্বের প্রায় সব দেশের ওপর এই শুল্ক কার্যকর হয়েছে। এই শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে পূর্ণোদ্যমে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তাঁর অর্থনৈতিক লক্ষ্যের জন্য এই শুল্ক গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের জবাবে চীন মার্কিন পণ্যে ৮৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। ১০ এপ্রিল থেকে এই শুল্ক কার্যকর হবে।
শেষ মুহূর্তে ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন। তবে চীনের সঙ্গে বানিজ্য যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। চীনের ওপর আরোপিত ১২৫ শতাংশ শুল্ক বজায় থাকবে। চীনও বলেছে যুত্তরাষ্ট্রের ওপর শুল্ক হার হবে ৮৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ কী করেছে
পাল্টা শুল্ক যে আসছে, তা গত ১৩ ফেব্রুয়ারিই ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে অনেক দেশই হয়তো বুঝতে পারেনি যে সবার ওপরেই আসলে শুল্ক বসবে, চীনই একমাত্র লক্ষ্য নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন। আর যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য–ঘাটতি আছে, এমন শীর্ষ ২৫ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আছে। সুতরাং বাংলাদেশ অবশ্যই ঝুঁকির মধ্যে ছিল। বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ৩৭ শতাংশ।
৫ এপ্রিল
বিশেষ বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন।
৬ এপ্রিল
সিদ্ধান্ত হয় প্রধান উপদেষ্টা একটি চিঠি দেবেন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে, বাণিজ্য উপদেষ্টা আরেকটি চিঠি দেবেন মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরকে।
৭ এপ্রিল
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। চিঠিতে প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশে শুল্ক-সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর, চিকিৎসাসামগ্রীর মতো বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রপ্তানি পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কমানোর কথা বলেন।
একই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) জেমিসন গ্রিয়ারকে আরেক চিঠি পাঠান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। চিঠিতে ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার কথা জানান।
৯ এপ্রিল
বাংলাদেশের জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কার্যকর। বাংলাদেশকে শুল্ক দিতে হবে সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ।
শেষ মুহূর্তে ট্রাম্প চীন ছাড়া সব দেশের জন্য পাল্টা শুল্ক স্থগিত করেছেন। তবে ১০ শতাংশ হারে যে শুল্ক সবার জন্য আরোপ করা হয়েছিল তা থাকবে। চীনের জন্য শুল্ক হবে ১২৫ শতাংশ। আর চীন আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ৮৪ শতাংশ।
শেষ কথা
বাণিজ্যের সব রীতিনীতি ভেঙে ফেলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। চোখ রাঙিয়ে কথা বলছে চীনও। ট্যারিফ যুদ্ধ ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে। বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কমে যাচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাপী মন্দা আসন্ন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এর শেষ কোথায় কারোরই জানা নেই।
শেষ মুহূর্তে অবশ্য ট্রাম্প পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন। তবে চীনের সঙ্গে বানিজ্য যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। পাল্টা জবাব দিচ্ছে চীনও। অর্থাৎ বাণিজ্য এখন যুদ্ধ ভিন্ন এক দিকে মোড় নিয়েছে। আর ৯০ দিন পরে কী হবে তাও অজানা। অর্থাৎ অনিশ্চয়তা রয়েই গেল।
১৯৩০ সালের ট্যারিফ যুদ্ধ শুরু করেছিলেন তৎকালীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুবার। সেবার ট্যারিফ যুদ্ধের পরিণতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মোটেই ভালো হয়নি। ইউরোপের বড় বড় অর্থনীতির দেশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিল, যেমন এবার করল চীন ও ইউরোপ। পাল্টা ট্যারিফ আরোপের ফলে ১৯২৯ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে তখন বিশ্ববাণিজ্য দুই-তৃতীয়াংশ কমে গিয়েছিল। বিশ্ববাণিজ্যে একা হয়ে পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ১৯৩২ সালের নির্বাচনে হেরে যান হার্বার্ট হুবার। নতুন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট দায়িত্ব নেওয়ার পরে আরোপিত ট্যারিফ প্রত্যাহার করে নেন। অর্থাৎ প্রথম ট্যারিফ যুদ্ধে চরম পরাজয় হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের।
সেই ট্যারিফ যুদ্ধ হার্বার্ট হুবারের রাজনৈতিক জীবনকেও শেষ করে দিয়েছিল। ১৯৩২ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী রুজভেল্টের কাছে হেরে যান। এরপর টানা চার নির্বাচনে কোনো রিপাবলিক প্রার্থীই আর জিততে পারেননি। ট্রাম্পের পরিণতিও কি হার্বার্ট হুবারের মতো হবে?
আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের কী হবে। বিশ্ববাণিজ্যের যেকোনো অনিশ্চয়তা ও মন্দায় একধরনের আত্মতৃপ্তিতে থাকে বাংলাদেশ। কারণ, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম কমে যায়। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ হ্রাস পায়। আর বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যের পোশাক তেমন রপ্তানি করে না। মন্দা দেখা দিলে সাধারণ উচ্চ মূল্যের পোশাকের চাহিদা কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশ নিত্যব্যবহার্য, কম দামের পোশাক বানিয়ে রপ্তানি করে। এসব পোশাকের চাহিদা কমে না। আবার চীনের ওপর যেকোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে বাংলাদেশের দিকেই ক্রেতারা চলে আসেন। ফলে পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশও বাড়ে। এবারও কি তা–ই ঘটবে? ছোট হওয়ার সুবিধা আর কত দিন পাবে বাংলাদেশ?
এ প্রশ্নের উত্তরও আসলে জানা নেই। এবার অনিশ্চয়তা এতটাই বেশি। কারণ, গত ১০০ বছরেও এ রকম ট্যারিফ যুদ্ধ কেউ কখনো দেখেইনি।