বন্ধ হয়ে গেল ব্যক্তিগত পেনশন বিমা পলিসি
দীর্ঘদিন ধরে জীবন বীমা করপোরেশনের (জেবিসি) সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিমা পলিসির নাম ছিল ‘ব্যক্তিগত পেনশন বিমা পলিসি।’ যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য এ ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হওয়ায় এ পলিসি এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। কারণ, জেবিসি গত ১ ডিসেম্বর থেকে এটাকে চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে।
জেবিসির মহাব্যবস্থাপক হান্নানুর রশীদ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত পেনশন বিমা পলিসি অলাভজনক। এ কারণে অ্যাকচুয়ারিয়াল পরামর্শক পলিসিটির বিপণন বন্ধ করার সুপারিশ করেছেন। ফলে এর বিক্রি কার্যক্রম বন্ধ করা হলো। এ সুপারিশ জেবিসির পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন করেছে বলে গত বছরের ২৮ নভেম্বর সংস্থার এক অফিস আদেশে সবাইকে জানানো হয়েছে।
এজেন্ট ও গ্রাহকদের লাভ হলেও পেনশন বিমা পলিসির কারণে সরকারের লোকসান হচ্ছিল। এ ছাড়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর পর থেকে সরকার চাইছিল ওদিকে মনোযোগ বাড়াতে।আবুল খায়ের মোহাম্মদ হাফিজুল্লাহ খান, জেবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)
অথচ জেবিসি বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছিল যে ব্যক্তিগত পেনশন বিমা পলিসির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, গ্রাহকের অকালমৃত্যুতে পরিবারের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান, যা অন্য কোনো সঞ্চয় পলিসির মাধ্যমেই সম্ভব নয়।
বিদায়ী ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট চালু হওয়ার পর থেকে পাঁচ মাসে সর্বজনীন পেনশনের চারটি স্কিমে মোট গ্রাহক হয়েছেন ১৭ হাজার ৯৯৫ জন। এ সাড়া আশানুরূপ নয় বলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষও মনে করছে। অথচ এ স্কিমের কারণে জেবিসির ব্যাপক জনপ্রিয় ব্যক্তিগত পেনশন বিমা পলিসিটিকে ‘অলাভজনক’ আখ্যায়িত করে বাতিল করা হয়েছে বলে সংস্থাটির কিছু কর্মকর্তা মত দিয়েছেন।
জেবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল খায়ের মোহাম্মদ হাফিজুল্লাহ খান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, এজেন্ট ও গ্রাহকদের লাভ হলেও পেনশন বিমা পলিসির কারণে সরকারের লোকসান হচ্ছিল। এ ছাড়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর পর থেকে সরকার চাইছিল ওদিকে মনোযোগ বাড়াতে। সব মিলিয়েই এটা বন্ধ করা হয়েছে। তবে বাতিল হওয়া পলিসিটি নিয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে বলেও জানান জেবিসির এমডি।
‘লোকসান হয়নি; বরং লোকসান দেখিয়ে জেবিসির একটি গোষ্ঠী সরকারকে ভুল বুঝিয়ে এটা বন্ধ করেছে।’শফিকুল ইসলাম মিয়াজী, মহাব্যবস্থাপক
কেমন ছিল পলিসিটি
বন্ধ হওয়া পলিসির নিয়মটা ছিল, এর আওতায় টাকা জমা দেওয়া শুরুর ১০ বছরের মধ্যে যেকোনো সময় বিমাগ্রহীতা মারা গেলে ১০ বছরের বাকি সময়ের জন্য পেনশনভোগীর নমিনি পেনশন পাবেন। পেনশন বিতরণ শুরুর নির্ধারিত তারিখের আগে বিমাগ্রহীতার স্বাভাবিক মৃত্যু হলে নমিনি চাইলে এককালীন অর্থও নিতে পারবেন।
এ পলিসির সঙ্গে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুবিমারও একটি সহপলিসি ছিল। পলিসি চালু থাকা অবস্থায় দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুবিমার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে অথবা দুর্ঘটনার কারণে ৯০ দিনের মধ্যে বিমাগ্রহীতা মারা গেলে বার্ষিক প্রিমিয়ামের ৩০ গুণ অর্থ পেতেন তাঁর নমিনিরা। এ ছাড়া ছিল মেয়াদপূর্তিতে পেনশনের টাকার ৫০ শতাংশ অথবা শতভাগ এককালীন তুলে নেওয়ার সুযোগ। বিমাপত্রের অনুকূলে বিমা গ্রাহক চাইলে ঋণও নিতে পারতেন। জীবনবিমার অন্য পলিসির মতো পেনশন বিমার টাকা আয়করমুক্ত ছিল। প্রিমিয়ামের টাকার ওপর আয়কর রেয়াতও মিলত।
মানুষের বোঝার জন্য জেবিসি উদাহরণ দিয়ে বলেছিল, ৩৫ বছর বয়স্ক একজন ৫৭ বছর বয়স পূর্তির পর থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা পেনশনের জন্য একটি পেনশন বিমা পলিসি গ্রহণ করেন। তাঁর এক বছরের প্রিমিয়াম ৯ হাজার ২১০ টাকা। ৫৭ বছর বয়স পর্যন্ত ২২ বছরে তাঁর মোট জমা দাঁড়াবে ২ লাখ ২ হাজার ৬২০ টাকা। এর বিনিময়ে গ্রাহক এককালীন ছয় লাখ টাকার পেনশন তুলে নিতে পারবেন। অথবা প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে পেনশন ভোগ করতে পারবেন তত দিন পর্যন্ত, যত দিন তিনি বেঁচে থাকবেন। গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে এ টাকা জমা হয়ে যাবে। চাইলে অর্ধেক টাকা এককালীন তুলে নিয়েও পেনশন ভোগ করার সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আজীবন মাসিক পেনশনের পরিমাণ হবে ২ হাজার ৫০০ টাকা।
পলিসিটি আবার বহালের দাবি
বন্ধ না করে বিকল্প ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছে জেবিসির তিনটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ঐক্যজোট। জোটের আহ্বায়ক জেবিসির মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম মিয়াজি ও সদস্য মো. আবুল খায়ের এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর কাছে আবেদন করেছেন। এতে তাঁরা বলেন, ব্যক্তিগত পেনশন বিমা পলিসি বন্ধ করে দেওয়ায় সংস্থা হিসেবে জেবিসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
আবেদনে বলা হয়েছে, পেনশন বিমায় বলা আছে, কেউ মারা গেলে একটি বার্ষিক প্রিমিয়ামের ১৫ গুণ অর্থ অথবা প্রথম প্রিমিয়াম ছাড়া সব প্রিমিয়াম ৭ শতাংশ সুদে ফেরত দেওয়া হয়। বর্তমানে ১১ শতাংশ সুদে ব্যাংকেই টাকা বিনিয়োগ করা যায়। তারপরও লোকসানের প্রশ্ন অবান্তর। বন্ধ না করে বরং এখন থেকে ২০ বছর পর কীভাবে একজন গ্রাহক মাসে এক লাখ টাকা পেনশন পেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা উচিত। তবে সচিব গতকাল পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেননি।
এ নিয়ে মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম মিয়াজী সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকসান হয়নি; বরং লোকসান দেখিয়ে জেবিসির একটি গোষ্ঠী সরকারকে ভুল বুঝিয়ে এটা বন্ধ করেছে।’
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সঙ্গে সম্প্রতি মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে জানান, এ বিষয়ে তাঁর কথা বলার সুযোগ নেই।