আছে রপ্তানিরও সম্ভাবনা
তেল ও সয়া কেকে বিনিয়োগ বাড়ছে
উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় অশোধিত সয়াবিন আমদানি কমছে। তেল ছাড়া কারখানা থেকে যা পাওয়া যায়, তা মাছ–মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহার হয়।
আমদানি করেই দেশে সয়াবিন তেল বাজারজাত হচ্ছে নব্বইয়ের দশক থেকে। বিদেশ থেকে অশোধিত তেল এনে দেশে শুধু পরিশোধন হতো। আর একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেশে সয়াবিন তেল উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
এ কারণে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে অশোধিত সয়াবিন আমদানিও কমছে। আবার তেল ছাড়া কারখানায় যা পাওয়া যাচ্ছে, তার পুরোটাই মুরগি, গবাদিপশু ও মৎস্য খাতে খাবারের জোগানও দিচ্ছে। সয়াবিন উৎপাদিত হলেও উদ্যোক্তাদের নজর মৎস্য ও প্রাণিখাদ্য ‘সয়া কেক’ বাজারজাত নিয়ে। তৈলবীজের মধ্যে সবচেয়ে কম তেল পাওয়া যায় সয়াবিন মাড়াই করে। কারখানায় ১০০ কেজি সয়াবিন মাড়াই করে ১৭ থেকে ১৮ কেজি অপরিশোধিত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়। সয়াকেক উৎপাদিত হয় ৭৮–৭৯ কেজি।
নতুন বিনিয়োগ নিয়ে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, দেশীয় বাজার ও রপ্তানির সম্ভাবনার কারণে এই খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। আগে সয়াকেক আমদানি হতো। এখন এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ায় আমদানির দরকার হবে না। অপরিশোধিত সয়াবিনও আসবে এই খাত থেকে। তাই এই খাতকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা উচিত।
এক বছরে তিন কারখানা
দেশে প্রথম সয়াবিন মাড়াইয়ের কারখানা গড়ে তুলেছে সিটি গ্রুপ। ২০০৭ সালে নারায়ণগঞ্জে ‘সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ নামের কারখানা চালু করে গ্রুপটি।
এই গ্রুপের পর ২০১১ সালে মেঘনা গ্রুপও নারায়ণগঞ্জে চালু করে সয়াবিন মাড়াই কারখানা। এত দিন দুটি গ্রুপের কারখানায় সীমিত আকারে তেল ও সয়াকেক উৎপাদিত হতো। কারখানা দুটির প্রতিটিতে দিনে দেড়–দুই হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন মাড়াইয়ের সক্ষমতা আছে। তাই সয়াবিন ও সয়াকেকের চাহিদা বাড়তে থাকায় সিটি ও মেঘনা গ্রুপ আরও দুটি বড় কারখানা চালুর উদ্যোগ নেয়। এ বছর কারখানা দুটি চালু হয়।
সিটি গ্রুপ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে গত ফেব্রুয়ারি মাসে চালু করেছে সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ ইউনিট–২ কারখানা। প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই কারখানায় প্রতিদিন ৫ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিনবীজ মাড়াই করার সক্ষমতা রয়েছে। আর মেঘনা গ্রুপও মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ‘সোনারগাঁ সিড ক্রাশিং মিলস লিমিটেড’ নামে নতুন কারখানা করেছে। এই কারখানায় বিনিয়োগ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। কারখানার উৎপাদিত তেল ও সয়াকেকের ৩০ শতাংশ রপ্তানি হবে বলে গ্রুপটি জানিয়েছে।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের সৈয়দপুরে নতুন কারখানা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে ‘ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’। এই সমন্বিত কারখানায় সয়াবিন মাড়াই ছাড়াও গম থেকে আটা–ময়দা প্রক্রিয়াজাত, ভোজ্যতেল পরিশোধন করা হবে। এতে মোট বিনিয়োগ হচ্ছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কারখানাটিতে বছরে আট লাখ মেট্রিক টন সয়াবিনবীজ মাড়াই করার সক্ষমতা রয়েছে।
দেশীয় বাজার ও রপ্তানির সম্ভাবনার কারণে এই খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। আগে সয়াকেক আমদানি হতো। এখন এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ায় আমদানির দরকার হবে না।মোস্তফা কামাল, চেয়ারম্যান, মেঘনা গ্রুপ
নতুন এই খাতে বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদা বাড়ায় প্রতিবছর প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এসব খাতের খাদ্যের অন্যতম উপাদান সয়াকেক। আবার সয়াবিন তেলের চাহিদাও বাড়ছে। সব মিলিয়ে এই খাতের সম্ভাবনা আছে।
আমিরুল হক আরও বলেন, কৃষিপণ্যটির প্রক্রিয়াজাত কারখানায় বিনিয়োগের বড় সুফল পাওয়া যাবে কৃষি খাতে। এখন দেশে সয়াবিনের চাষ বাড়বে। তাতে সয়াবিন তেলের আমদানিনির্ভরতাও কমবে।
এই তিন গ্রুপের পাঁচটি কারখানা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জে ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্লোব এডিবল অয়েল নামে ভোজ্যতেল কারখানা চালু করেছে গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। গ্রুপটির চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে জানান, ২০১৮ সাল থেকে কারখানায় সূর্যমুখীবীজের পাশাপাশি সয়াবিনবীজ মাড়াই করে সয়াবিন তেল ও সয়াকেক উৎপাদিত হচ্ছে।
বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও ধানের কুঁড়া থেকে তেল উৎপাদনকারী দুটি প্রতিষ্ঠান এখন সয়াবিনবীজ মাড়াই করে তেল ও সয়াকেক উৎপাদন করছে। এ দুটি হলো রাজশাহীতে যমুনা এডিবল অয়েল কোম্পানি ও ঢাকার ধামরাইয়ে কেবিসি অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড।
আমদানিনির্ভরতা কমাবে
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এখন সিটি, মেঘনা ও গ্লোবের পাঁচটি কারখানা উৎপাদনে আছে। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠান দুটির বড় দুটি কারখানা উৎপাদন শুরু করায় সয়াকেক আমদানির দরকার হবে না। আবার সয়াবিন আমদানিও ধারাবাহিকভাবে কমবে। এরই মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি কমতে শুরু করেছে।
গত অর্থবছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া সাত লাখ মেট্রিক টন অশোধিত সয়াবিন তেল খালাস করেছেন উদ্যোক্তারা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। এ সময়ে প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত সয়াবিন উৎপাদনের সমপরিমাণ কাঁচামাল আমদানি করেছেন উদ্যোক্তারা। অপরিশোধিত সয়াবিন আমদানিও কমেছে তিন লাখ মেট্রিক টন।
তবে দেশে উৎপাদন হলেও সয়াকেক আমদানি খুব কমছেও না। আবার খুব বেশিও বাড়ছে না। প্রতিবছর তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টন সয়াকেক আমদানি হচ্ছে। গত অর্থবছরে বন্দর দিয়ে ৩ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন সয়াকেক আমদানি হয়।
কৃষিপণ্যটির প্রক্রিয়াজাত কারখানায় বিনিয়োগের বড় সুফল পাওয়া যাবে কৃষি খাতে। এখন দেশে সয়াবিনের চাষ বাড়বে। তাতে সয়াবিন তেলের আমদানিনির্ভরতাও কমবে।আমিরুল হক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ
কাঁচামাল ও প্রস্তুত পণ্যে একই শুল্কহার
সয়াবিন মাড়াই কারখানার উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশ এখন সয়াকেক উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এরপরও প্রস্তুত পণ্য অর্থাৎ সয়াকেক আমদানিতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়। তেল ও সয়াকেক উৎপাদনের বড় বিনিয়োগের পর এমন সিদ্ধান্তে উদ্যোক্তারা হতাশ।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যে ব্যবহৃত সয়াকেক আমদানির তালিকায় প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান থাকলেও নিয়মিত আমদানি করছে ১৫টি। সয়াকেক আমদানির ৬২ শতাংশই আনা হচ্ছে আর্জেন্টিনা থেকে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হচ্ছে ১৭ শতাংশ। উদ্যোক্তারা জানান, মূলত আমদানিতে এক বছরের ঋণসুবিধা পাওয়া যায়। আমদানি ও দেশে উৎপাদিত সয়াকেকের দাম প্রায় একই হলেও ঋণসুবিধার কারণেই আমদানিতে আগ্রহ বেশি আমদানিকারকদের।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, দেশের চাহিদার চেয়ে সয়াকেক উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি। আমদানির প্রয়োজন নেই। দেশীয় শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে আগের মতো প্রস্তুত পণ্যে ১৫ শতাংশ শুল্ক–কর বহাল রাখা উচিত।
সম্ভাবনা অনেক
সয়াবিনমাড়াই কারখানা শুধু আমদানিনির্ভরতা কমাবে না। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিরও সুযোগ বাড়ছে। দেশে এখন তৈলবীজ থেকে উৎপাদিত কেকের প্রধান রপ্তানি বাজার নেপাল ও ভারত। গত অর্থবছরে সয়াবিন, শর্ষেসহ উদ্ভিজ প্রোটিন পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ ডলারের। এত দিন শর্ষেসহ বিভিন্ন প্রাণিখাদ্য থাকলেও এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে সয়াবিন কেক।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, চীন ও মিয়ানমারেও রপ্তানির সম্ভাবনা আছে। আবার সয়াবিন মাড়াই কারখানার কাঁচামাল সয়াবিনের ৯৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। দেশে এখন চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ সয়াবিনবীজ উৎপাদিত হচ্ছে। তবে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসায় কৃষি খাতেও সয়াবিনবীজ উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করছেন তাঁরা। এর কারণ হিসেবে উদ্যোক্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম ৩৮০ থেকে ৪০০ ডলার। ভালো দাম থাকায় ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বাড়লে এক দশক পর সয়াবিনবীজও আমদানির প্রয়োজন হবে না।