সিমেন্টশিল্প খাত
এবার বাড়ছে সিমেন্টের কাঁচামালের দাম
সিমেন্ট কারখানার মালিকেরা বলছেন, আমদানির ক্ষেত্রে সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম টনপ্রতি বেড়েছে ৪ মার্কিন ডলার বা ৩৪০ টাকা।
করোনার ধাক্কা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসার পরই বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। তাতে বিশ্ববাজারে শিল্পের কাঁচামালের দাম বাড়ছে। এই তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছে সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকারের দামও। ইতিমধ্যে একটি বহুজাতিক কোম্পানি সিমেন্টের দাম বাড়ানোর, অর্থ্যাৎ কাঁচামালের দামের সঙ্গে সিমেন্টের দাম সমন্বয়ের ঘোষণা দিয়েছে। তবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো দাম বাড়ায়নি। দেশীয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে তারা করভার সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্ববাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের দাম দুইভাবে বাড়ছে। ক্লিংকার তৈরির খরচ বাড়ায় রপ্তানিকারক পর্যায়ে যেমন দাম বাড়ছে, তেমনি জাহাজভাড়া বাড়ায় তা আমদানি মূল্যের সঙ্গে যোগ হচ্ছে। সব মিলিয়ে টনপ্রতি ক্লিংকারের দাম বেড়েছে ৪ মার্কিন ডলার বা ৩৪০ টাকা।
সিমেন্টশিল্পে পাঁচ ধরনের কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়। সব কটি আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে ৬২ শতাংশই হলো ক্লিংকার। গত অর্থবছরও দেশে ১ কোটি ৮৭ লাখ টন ক্লিংকার আমদানি হয়েছে। টনপ্রতি বাড়তি ৪ ডলার হিসেবে প্রতি মাসে শুধু ক্লিংকার আমদানি বাবদ বাড়তি ব্যয় হবে ৬২ লাখ ডলার বা ৫৩ কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় এখন দেশে প্রস্তুত সিমেন্টের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে দ্বৈত কর সমন্বয় করা উচিত।
সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় এখন দেশে প্রস্তুত সিমেন্টের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে দ্বৈত কর সমন্বয় করা উচিত। এ ছাড়া আমদানি পর্যায়ে নির্ধারিত শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২৫০ টাকা নির্ধারণ করার দাবি জানান তিনি। নির্মাণ খাতের অন্যতম উপকরণটির কারণে যাতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য করভার কমানোর অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, দাম সহনীয় রেখে যদি বিক্রি বাড়ে, তাহলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।
বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অনেক দেশে করোনার ধাক্কা সামলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। নভেম্বরের শুরুতে এর প্রভাব পড়ে ইস্পাতশিল্পে। রড তৈরির প্রধান উপকরণ পুরোনো লোহার টুকরার দামে এখনোও চলছে উত্থান-পতন। একইভাবে ক্লিংকার তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল কয়লার দাম বাড়ায় প্রভাব পড়ে ক্লিংকারের দামেও। আবার সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের চাপে জাহাজভাড়া গত নভেম্বর থেকেই উর্ধ্বমুখী। তাতে নির্মাণ খাতের অন্য উপকরণের মতো এটিরও দাম বাড়ছে।
নির্মাণশিল্পের প্রধান উপকরণের মধ্যে পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় সিমেন্ট। করোনার শুরুতে এই খাত বিপর্যস্ত হয়েছে। তবে খুব দ্রুতই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে খাতটি। গত বছরের শেষ ৬ মাসে ২০১৯ সালের তুলনায় সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানি বেড়েছে ২২ শতাংশ। নির্মাণ খাতের অন্য উপকরণ রডের দাম বাড়লেও সিমেন্টের দাম স্থিতিশীল ছিল। তাতে এই খাতে বিক্রিও বেড়েছে।
সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তারা জানান, বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নের প্রধান উপকরণের মধ্যে আছে সিমেন্ট, রড, পাথর ও ইট। এসব নির্মাণ উপকরণের সামনে চাহিদা বাড়বে। পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণ বঙ্গের ২১টি জেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হবে। এই ২১টি জেলায় শিল্পকারখানা, বাণিজ্যিক ভবনের মতো অবকাঠামো তৈরি হবে। ঢাকার ছোট-বড় শিল্পকারখানা স্থানান্তর হবে। নতুন কারখানা হবে। আবার কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ শেষ হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামে অবকাঠামো উন্নয়নে গতি বাড়বে। এতে অবকাঠামো নির্মাণের প্রধান উপকরণ সিমেন্টের চাহিদা বাড়বে। এই উপকরণের দাম যদি অস্থিতিশীল হয়, তাহলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও স্থবির হবে। ইতিমধ্যে রডের দাম বাড়ায় দেশে জরুরি ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ে অবকাঠামো নির্মাণে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, সিমেন্ট খাতে এখন তীব্র প্রতিযোগিতা। এ কারণে কাঁচামালের দাম বাড়লেও তাঁরা অন্য খরচ কমিয়ে মূল্য সমন্বয় করে নিচ্ছেন। তবে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বেশি বাড়লে এখানেও মূল্য সমন্বয় করতে হবে।
সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির হিসাবে, বর্তমানে দেশে ৩৭টি সিমেন্ট কারখানা রয়েছে। গত ৬ বছরে সিমেন্ট বিক্রিতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০১৬ সালে। ২০১৫ সালের তুলনায় সে বছর ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। এরপর ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে সিমেন্ট বিক্রি বেড়েছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। সে বছর দেশে ৩ কোটি ১৩ লাখ টন সিমেন্ট বিক্রি হয়। অর্থাৎ ১ বছরে বাড়তি ৪৩ লাখ টন সিমেন্ট বিক্রি হয়েছিল। ২০২০ সাল বাদ দিলে বছরে গড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই খাতে।