এক কাজ করতে দুই সংস্থা
পণ্য ও সেবার মান নিয়ন্ত্রণে তিন দশক আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মতো আরেকটি প্রতিষ্ঠান খুলতে চায় শিল্প মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত এই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘বাংলাদেশ কোয়ালিটি কাউন্সিল’।
এটি গঠনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, পণ্য ও সেবার গুণগত মানের উন্নয়ন করা। অথচ বিএসটিআই গঠনের মূল লক্ষ্যও একই, পণ্য ও সেবার মান ঠিক করে দেওয়া। একই কাজের জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান চালুর প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল, তা নিয়ে খোদ বিএসটিআইই প্রশ্ন তুলেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পণ্য ও সেবার গুণগত মানোন্নয়নের পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠান আইএসও সার্টিফিকেট দেয়, তাদের একটা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতেই কোয়ালিটি কাউন্সিল গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই কাউন্সিল কীভাবে চলবে, সেই নির্দেশনা দিতে আইনের খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। খসড়া নিয়ে এরই মধ্যে দুই দফা বৈঠকও করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। খসড়ায় বলা হয়েছে, গুণগত মান সনদ, যেমন আইএসও ৯০০১ ও আইএসও ১৪০০১ প্রদানকারী দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে এই কাউন্সিলে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করতে হবে।
নতুন প্রতিষ্ঠান হলে কাজের কাজ কতটুকু হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। এতে ব্যবসায়ীদের হয়রানি ও ভোগান্তি বাড়তে পারে। সেটি আবার মাথাভারী প্রতিষ্ঠান হয় কি না, তা-ও দেখার বিষয়।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত আইন, তথা খসড়ার ওপর অন্তত ১০টি মতামত দিয়েছে বিএসটিআই। সংস্থাটি শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো মতামতে বলেছে, বিএসটিআই এখন যে ধরনের কাজ করে, কোয়ালিটি কাউন্সিলেরও প্রায় একই ধরনের কাজ করার কথা বলা হয়েছে। শুধু একটি জায়গায় পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। সেটি হলো, যারা আইএসও সনদ দেয়, তাদের একই ছাতার নিচে নিয়ে আসতে কাউন্সিলে অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে, যেটি বিএসটিআই করে না। নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্ম না দিয়ে বিএসটিআইকে দিয়ে কাজটি করানো যেতে পারে। পাশাপাশি বিএসটিআইকে শক্তিশালী করা যেতে পারে।
জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক নজরুল আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ কোয়ালিটি কাউন্সিল আইনের খসড়া দেখে আমরা সেটির ওপর আমাদের কিছু মতামত শিল্প মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি।’
একটি প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান থাকতে প্রায় একই কাজের জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান চালু করা কতটা জরুরি ও যৌক্তিক, জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন প্রতিষ্ঠান করার চেয়ে বিদ্যমান বিএসটিআইকে শক্তিশালী করে সেটির মাধ্যমে সার্টিফিকেশন দিলেই ভালো হবে। সে ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। তিনি বলেন, নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। নতুন প্রতিষ্ঠান হলে তখন কাজের কাজ কতটুকু হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। এতে ব্যবসায়ীদের হয়রানি ও ভোগান্তি বাড়তে পারে। সেটি আবার মাথাভারী প্রতিষ্ঠান হবে কি না, তা-ও দেখার বিষয়।
আমরা সবার সঙ্গে আবার বসব। নতুন কোনো অফিস কিংবা আইনের দরকার আছে কি না, সবার মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।
পুরোনো অভিযোগ, বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখে পড়তে হয়। দেশি-বিদেশি কোনো উদ্যোক্তা যদি এ দেশে ব্যবসা শুরু করতে চান, তাহলে তাঁকে প্রথমে নিবন্ধনের জন্য যেতে হয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে। এরপর ওই উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপি), বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথবা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা)—এসব কার্যালয়ে ঘুরতে হয়। বিনিয়োগের জন্য এত সরকারি প্রতিষ্ঠান না রেখে একটি প্রতিষ্ঠান রাখলে বিনিয়োগকারীদের হয়রানি ও ভোগান্তি কমে আসবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদেরা।
বাংলাদেশ কোয়ালিটি কাউন্সিল আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কাউন্সিলের কার্যালয় হবে ঢাকায়। কাউন্সিলে একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান থাকবেন। গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকবেন শিল্পমন্ত্রী। কমিটির সদস্য হবেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংস্থার প্রধানসহ মোট ৩২ জন। গভর্নিং বোর্ড বছরে চারবার বৈঠক করবে। প্রতিবার বৈঠকে ৫০ শতাংশ উপস্থিতি থাকলে কোরাম পূর্ণ হবে।
কোনো বিদেশি সনদ প্রদানকারী সংস্থা বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তি বা এজেন্সি নিয়োগ করতে চাইলে তাদের বাংলাদেশ কোয়ালিটি কাউন্সিল থেকে অনুমোদন নিতে হবে। গুণগত মান সনদ, যেমন আইএসও ৯০০১, আইএসও ১৪০০১ দেওয়ার পর সনদের একটি অনুলিপি কাউন্সিলে জমা দিতে হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কোয়ালিটি কাউন্সিলের নামেই একটি তহবিল থাকবে, যেখানে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া অনুদান রাখা হবে। এটি সরকার অনুমোদিত উৎস থেকে ঋণ নিতে পারবে। নিবন্ধন ফি ছাড়াও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের বিপরীতে পাওয়া সুদের টাকা দিয়ে চলবে সংস্থাটি।
দেশে পণ্য ও সেবার মান নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিএসটিআই। তবু প্রায় একই কাজের জন্য আরেক প্রতিষ্ঠান গঠনের পরিকল্পনা। আইনের খসড়াও তৈরি।
গুণগত মান সনদ প্রদানকারী দেশি-বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য এই কাউন্সিল থেকে নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তা না করলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এমন অপরাধের জন্য ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনধিক এক লাখ টাকা জরিমানা করতে পারবে কাউন্সিল। আর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পুনরায় অপরাধ করলে অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। একই সঙ্গে অনাদায়ে সনদ বাতিল করা হবে।
জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (আইন) এ এফ এম আমীর হোসেন বলেন, ‘আমরা সবে আইনের খসড়া তৈরি করেছি। খসড়া নিয়ে আমরা দুই দফা বৈঠক করেছি। বৈঠকে বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধিও ছিলেন, কিন্তু তখন তাঁরা কিছু বলেননি। এখন বিএসটিআই বলছে, প্রস্তাবিত আইন তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা সবার সঙ্গে আবার বসব। নতুন কোনো অফিস কিংবা আইনের দরকার আছে কি না, সবার মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’