ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার এবং ১০ শিল্পগোষ্ঠীর প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার শেয়ার জব্দ করেছে আদালত। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা তাঁদের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে ও ৮৪ জনকে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে থাকা তাঁদের কিছু সম্পদও জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদুক) আবেদনে তাদের অর্থ ও সম্পদ জব্দ করা হয়। এসব অর্থের মধ্যে বিদেশি মুদ্রা ও বিদেশে থাকা সম্পদও রয়েছে।
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তসংস্থা টাস্কফোর্সের সভায় এসব তথ্য জানানো হয়। এসব ঘটনায় দ্রুততম সময়ে মামলা করে তা নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়া হয় সভায়। এরপর বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে গতকাল দুপুরে আন্তসংস্থা টাস্কফোর্সের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শেখ পরিবার ও ১০ শিল্পগোষ্ঠীর অনিয়ম ও অর্থ পাচার নিয়ে আলোচনা হয়। শেখ হাসিনার পরিবারের বাইরে যে ১০ শিল্পগোষ্ঠীর আর্থিক অনিয়ম নিয়ে তদন্ত চলছে, সেগুলো হলো এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও আরামিট গ্রুপ। এসব গ্রুপের পাশাপাশি গ্রুপের প্রধান ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত আর্থিক বিষয়ও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। তাঁদের কয়েকজন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন।
অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরপরই এসব বিষয়ে জোরেশোরে কাজ শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুদকের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ তদন্ত দল। সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আর এ কাজের জন্য পুনর্গঠন করা হয় আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স।
এই টাস্কফোর্সের কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করা। পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করা। বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া। জব্দ বা উদ্ধার সম্পদের ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশি–বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য বিনিময় এবং পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেখ পরিবার ও দেশের ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিষয়ে বিএফআইইউ নিজে ও বিভিন্ন দেশের এফআইইউ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে এসব শিল্পগোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা কত টাকা ঋণ নিয়েছেন, এসব অর্থের গতিপথ, দেশের বাইরে কোথায় কত সম্পদ গড়ে তুলেছেন ও বাইরের ব্যাংকে কত অর্থ জমা আছে। এ ছাড়া ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতির তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি কর ফাঁকি, পাচার করা অর্থের গন্তব্য—এসব অনিয়ম কোন আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য, তা নির্ধারণ করছে দুদক, এনবিআর ও সিআইডি। ইতিমধ্যে বেশির ভাগ ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। আরও মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তে শেখ পরিবার ও আটটি শিল্পগোষ্ঠীর বিদেশে সম্পদের খোঁজ মিলেছে। সংশ্লিষ্ট দেশের এফআইইউ এ নিয়ে বাংলাদেশকে তথ্য ও নথিপত্র দিয়েছে। এখন দেশে মামলার মাধ্যমে এসব সম্পদ জব্দের আদেশ দেওয়া হচ্ছে। বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতে মামলা করা হবে। এরপর সে দেশ থেকে রায় হলে সম্পদ জব্দ হবে।
তদন্তের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে বিশেষ অধ্যাদেশ তৈরির কাজ চলছে। অধ্যাদেশ তৈরি হলে সেটির আলোকে বিদেশে চিহ্নিত হওয়া সম্পদ জব্দ ও তা আইনি পদ্ধতিতে ফেরত আনতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হবে। কমিশন ভিত্তিতে এই কাজ পাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এরপর অর্থ ফেরত আনতে কয়েক বছর সময় লাগবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে কাউকে সম্পদ কেনার জন্য বিদেশে অর্থ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে যাঁরা সম্পদ গড়েছেন, সবাই অপরাধ করেছেন।