রপ্তানিতে বড় চমক চামড়াবিহীন জুতা

ফ্যাশনেবল, টেকসই ও সাশ্রয়ী দামের কারণে চামড়াবিহীন জুতা বা নন–লেদার ফুটওয়্যারের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকেও এই পণ্যের রপ্তানি কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে রপ্তানিতে বড় চমক দেখিয়েছে চামড়াবিহীন জুতা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২৭ কোটি ৩৯ লাখ মার্কিন ডলারের চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৯ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১৯ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানি হয়েছিল।

চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানির সিংহভাগই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ইউরোপের মানুষ খুব প্রয়োজন নয়, এমন জিনিসপত্র কেনাকাটা কমিয়ে দেন। সে কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি কমে যায়। মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করলে পরের অর্থবছর রপ্তানি সামান্য বাড়ে। অন্যদিকে বিশ্বের শীর্ষ জুতা রপ্তানির দেশ চীন থেকে বিভিন্ন কারণে ক্রয়াদেশ সরাচ্ছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। সে জন্য বিদায়ী বছর বাড়তি ক্রয়াদেশ পেয়েছে বাংলাদেশ। তাই সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে প্রথমার্ধে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

বাংলাদেশের জুতাশিল্প প্রায় ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় আনছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৯৬ কোটি ডলারের জুতা। তার মধ্যে চামড়াবিহীন জুতা ৪১ দশমিক ৬৮ কোটি ডলারের। করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ ধরনের জুতা রপ্তানি ছিল ২৭ কোটি ডলার। পরের তিন বছরে সেটি বেড়ে ৪৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর দেশগুলোয় উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে পরের বছর রপ্তানি কমে ৩৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। তারপর আবার বাড়তে থাকে।

অবশ্য জুতা রপ্তানিতে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা এখনো খুবই কম। জুতা রপ্তানিতে চীন সবার ওপরে। বিশ্বে মোট জুতা রপ্তানির ৬০ শতাংশ করে দেশটি। এরপর রয়েছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানি, তুরস্ক, ভারত, বেলজিয়াম, ইতালি, কম্বোডিয়া ও স্পেন।

ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যারের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০২৩ সালে ২ হাজার ২৪০ কোটি জোড়া জুতা উৎপাদিত হয়েছে। তার মধ্যে ১ হাজার ৪০০ কোটি জোড়া জুতা রপ্তানি হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১৬৮ বিলিয়ন বা ১৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আর রপ্তানি হওয়া জুতার বড় অংশই চামড়াবিহীন। বিদায়ী বছরের জুতা উৎপাদন ও রপ্তানির তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি সংস্থাটি।

২০২৩ সালে বৈশ্বিক জুতা রপ্তানির ৬৩ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল চীনের দখলে। দেশটি ওই বছর রপ্তানি করে ৮৯৬ কোটি জোড়া। তারপরের শীর্ষ ৯ দেশের মধ্যে ভিয়েতনাম ১৩৪ কোটি জোড়া, ইন্দোনেশিয়া ৪৫, জার্মানি ৩৫, তুরস্ক ৩০, ভারত ২৬, বেলজিয়াম ২২, ইতালি ১৯, কম্বোডিয়া ১৬ কোটি ও স্পেন ১৫ কোটি জোড়া জুতা রপ্তানি করেছে।

জুতা রপ্তানিতে শীর্ষ দশে না থাকলেও বিশ্বে পণ্যটির শীর্ষ ভোক্তা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। এ ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে রয়েছে চীন। দ্বিতীয় ভারত। ২০২৩ সালে চীনে ৩৫৩ কোটি জোড়া, ভারতে ২৫৬, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩, ব্রাজিলে ৭৭ ও জাপানে ৬১ কোটি জোড়া জুতার চাহিদা ছিল। সে বছর বাংলাদেশে জুতার চাহিদা ছিল ৩৫ কোটি জোড়া।

দেশে চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানির জন্য ময়মনসিংহের ভালুকায় পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তুলেছে ন্যাশনাল পলিমার (এনপলি) গ্রুপ। এনপলি ফুটওয়্যার (আগের নাম শুনিভার্স ফুটওয়্যার) কারখানাটিতে মাসে ৩ লাখ ৬০ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন হয়। মাসে রপ্তানি ২৫ লাখ ডলারের জুতা। এখানে কাজ করেন তিন হাজার শ্রমিক।

রপ্তানিতে সম্ভাবনা থাকায় চার মাস আগে সক্ষমতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে জানান এনপলি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী মার্চ পর্যন্ত কারখানার পুরো সক্ষমতা অনুযায়ী ক্রয়াদেশ রয়েছে। আগামী দিনে এমন ক্রয়াদেশ থাকলে কারখানা দুই শিফটে চালানোর পরিকল্পনা করছি আমরা। তাতে উৎপাদন দ্বিগুণ হবে।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে রিয়াদ মাহমুদ বলেন, করোনার ধাক্কার পর চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরানো শুরু করেন অনেক বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। সেটির সুফল আমরা কিছুটা পেয়েছি। ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর চীন থেকে নতুন করে ক্রয়াদেশ সরবে। তুলনামূলক সস্তা শ্রম থাকায় বাংলাদেশের দিকে নজর আছে। চীনা ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে বিনিয়োগও আসবে। চামড়াবিহীন জুতাকে আগামী দিনে বড় রপ্তানি খাত হিসেবে গড়ে তুলতে দেশের ভেতরে জুতার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া দক্ষ লোকবল গড়ে তোলায়ও জোর দিতে হবে।’