প্রবৃদ্ধি ৭.৩৬ শতাংশ
কনটেইনার পরিবহনে নতুন উচ্চতায় চট্টগ্রাম বন্দর
সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে এই বন্দর দিয়ে পৌনে ৩৩ লাখ একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে সোয়া দুই লাখ বেশি।
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দিয়ে ২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল। বছরের মাঝামাঝি থেকে ছিল আন্দোলন–বিক্ষোভ। একপর্যায়ে সরকার পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরও অস্থিরতা। অর্থনৈতিক সংকট লেগে ছিল বছরের শুরু থেকে। আমদানি–রপ্তানি পণ্য পরিবহনে এসব প্রভাবের মুখোমুখি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। তবুও বছর শেষে পণ্য পরিবহনে নতুন রেকর্ড গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।
বন্দরের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩২ লাখ ৭৫ হাজার একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে সোয়া দুই লাখ একক কনটেইনার। এ হিসাবে কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। বন্দরের কনটেইনার পরিবহনের হিসাবে এটিই এখন সর্বোচ্চ রেকর্ড। এই রেকর্ড হয়েছে মূলত রপ্তানি পণ্য পরিবহনের প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে।
২০২৪ সালজুড়ে নানা সমস্যার পরও নতুন এই রেকর্ড হয়েছে। বন্দরের সক্ষমতাও বেড়েছে। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো জাহাজের গড় অবস্থান সময় কমেছে।রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান, চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম বন্দর
চট্টগ্রাম বন্দরের মূল জেটি, কমলাপুর কনটেইনার ডিপো ও পানগাঁও নৌ টার্মিনালে কনটেইনার পরিবহনের এই হিসাব দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। এর মধ্যে আমদানি–রপ্তানি পণ্যবাহী ও খালি কনটেইনারও রয়েছে। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ২০২১ সালে। সেবার ৩১ লাখ ১৪ হাজার একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বুধবার বন্দর জেটিতে সাংবাদিকদের বলেন, ২০২৪ সালজুড়ে নানা সমস্যার পরও নতুন এই রেকর্ড হয়েছে। বন্দরের সক্ষমতাও বেড়েছে। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো জাহাজের গড় অবস্থান সময় কমেছে। ২০২৪ সালে নানা বাধা পেরিয়ে এই অর্জনে বন্দরের পাশাপাশি কাস্টমস ও বন্দর ব্যবহারকারীসহ সবার অবদান রয়েছে।
রপ্তানিতে ভর করে সাফল্য
সাধারণত দেশের শিল্প খাতে উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়লে কনটেইনার পরিবহন বাড়ে। কারণ, কয়েকটি ছাড়া সব শিল্পকারখানার কাঁচামাল কনটেইনারে আমদানি হয়। এ তালিকায় আছে পোশাক, ওষুধ, জুতা, ইস্পাত, বাণিজ্যিক পণ্য, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি। আবার রপ্তানি পণ্যের প্রায় পুরোটাই পাঠানো হয় কনটেইনারে।
বিদায়ী বছরের কনটেইনার পরিবহনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সার্বিক কনটেইনার পরিবহনের প্রবৃদ্ধির চেয়ে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহনের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। যেমন বিদায়ী বছরে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ৮ লাখ ১৩ হাজার একক। ২০২৩ সালে ছিল সাত লাখ একক। সেই হিসাবে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। তবে আমদানি ও খালি কনটেইনারে প্রবৃদ্ধি ছিল রপ্তানির চেয়ে কম।
রপ্তানি খাতের বড় অংশই তৈরি পোশাকশিল্পের। তৈরি পোশাকশিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এস এম নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নানা প্রতিকূলতার পরও তৈরি পোশাক খাত ভালো করেছে। কমপ্লায়েন্স কারখানাগুলোতে ক্রয়াদেশ ছিল। ক্রেতাদের চাহিদাও বাড়ছে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়ায় মূলত বন্দরে কনটেইনার পরিবহনে রেকর্ড হয়েছে। কারণ, রপ্তানি কনটেইনারের বেশির ভাগই তৈরি পোশাকের। আবার কাঁচামাল আমদানি হয় কনটেইনারে।
বেড়েছে সেবার মান
শুধু কনটেইনার পরিবহন বাড়লেও বন্দরের সেবার মানের ওপর নির্ভর করে বৈদেশিক বাণিজ্যে খরচ কেমন বাড়ছে? জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় বন্দর জলসীমায় আসার পর একেকটি জাহাজ জেটিতে ভিড়তে অপেক্ষা করতে হয়েছে চার থেকে পাঁচ দিন। অর্থাৎ পণ্য হাতে পেতে চার–পাঁচ দিন বাড়তি সময় লেগেছে। আর এখন পণ্য হাতে পেতে এক দিনের কম সময় লাগছে। যেমন গতকাল বুধবার সকালে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ছিল নয়টি জাহাজ, এর পাঁচটিই দিনে দিনে জেটিতে ভেড়ানো হয়েছিল। চারটি ভিড়েছে এক দিন পর।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বন্দরগুলোর পণ্য পরিবহনের তথ্য তুলনা করে দেখা যায়, সমুদ্রপথে বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮৭ শতাংশই আনা–নেওয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে। পায়রা ও মোংলা বন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া হয় ১৩ শতাংশ পণ্য। তবে কনটেইনার পরিবহনের ৯৯ শতাংশই আনা-নেওয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, বেসরকারি খাতে পরিচালিত নবনির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল এখনো পুরোদমে চালু হয়নি। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান টার্মিনালগুলো ব্যবস্থাপনা করে এই সেবা দিয়েছে। পতেঙ্গা টার্মিনাল পুরোদমে চালু হলে সামনে কনটেইনার পরিবহন আরও বাড়বে।
বেড়েছে পণ্য পরিবহনও
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে ২০২৪ সালে মোট পণ্য (কনটেইনারের পণ্যসহ) পরিবহন হয়েছে ১২ কোটি ৩৯ লাখ টন। ২০২৩ সালে ছিল ১২ কোটি ২ লাখ টন। সেই হিসাবে সব ধরনের পণ্য পরিবহনে ৩ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
কনটেইনার ছাড়া সাধারণ পণ্যের মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, সিরামিকস ও ইস্পাতশিল্পের কাঁচামাল, পাথর, সার, ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি তেল ইত্যাদি। সাধারণ পণ্য জেটির পাশাপাশি বিশেষায়িত জেটি ও বহির্নোঙরে খালাস হয়।