পোশাকশিল্পে তদারকি কমেছে, বছর বছর দুর্ঘটনা বেড়েছে

  • ৮৫৬টি পোশাক কারখানা কোনো তদারকি ব্যবস্থার মধ্যে নেই।

  • আইএসইউর অধীনে থাকা ৬৭৯ কারখানার ত্রুটি সংশোধন হয়েছে মাত্র ৫৪%।

  • গত কয়েক মাসে আরএসসির ফলোআপ পরিদর্শন ব্যাপকভাবে কমেছে

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা অর্জন ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়
ছবি প্রথম আলো

১০ বছরেও দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও ভবনের কাঠামোগত ত্রুটি সংশোধনের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি এক-চতুর্থাংশ বা ৮৫৬টি পোশাক কারখানা কোনো ধরনের তদারকি ব্যবস্থার মধ্যে নেই। তাতে কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানায় গত কয়েক বছরে অগ্নিদুর্ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। যেমন ২০২০ সালে ১৭৭টি, ২০২১ সালে ১৮০টি ও ২০২২ সালে ২৪১টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। যে কারণে পোশাকশিল্পে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাও শূন্যে নামেনি। ২০২১ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৩ জন পোশাকশ্রমিক। গত বছর মৃত্যু হয়েছে চারজনের।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সিপিডির গবেষকেরা বলছেন, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশ তদারকির দায়িত্বে থাকা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে (ডিআইএফই) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করা জরুরি। যেসব প্রতিষ্ঠান ত্রুটি সংশোধন কাজে অনাগ্রহ দেখাবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নেবে এই অধিদপ্তর। তদারকি কাজে নিয়োজিত আরেক প্রতিষ্ঠান আরএসসিকে অ্যাকর্ডের সুনাম ধরে রেখে কাজ করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে নিয়মিত তথ্য-পরিসংখ্যানও প্রকাশ করা প্রয়োজন।

গত ১০ বছরে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে অনেক কাজ হলেও ত্রুটি সংশোধনপ্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হয়নি। ফলে নিরাপত্তাঝুঁকি রয়েই গেছে

রাজধানীর ধানমন্ডিতে গতকাল বুধবার ‘তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা অর্জন ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামীম আহমেদ। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কর্মপরিবেশের উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে হবে। পাকিস্তানের পোশাক ও বস্ত্র খাতের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকর্ড কার্যক্রম শুরু করেছে। আগামী দিনে ভারত, মরক্কো ও ইন্দোনেশিয়ায় কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ফলে পরিদর্শন কার্যক্রমে গাফিলতি থাকলে ভবিষ্যতে প্রতিযোগী দেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে হবে।

২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স দেশের পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশের উন্নয়নে কাজ শুরু করে। অ্যাকর্ড চলে যাওয়ার পর দায়িত্ব নেয় আরএমজি সাসটেইনিবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি)। আর অ্যালায়েন্সের দায়িত্ব নেয় ‘নিরাপন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

সিপিডি বলছে, আরএসসির অধীনে বর্তমানে ১ হাজার ৮৮৭টি পোশাক কারখানা রয়েছে। নিরাপনের অধীনে আছে ৩২০টি। যদিও বর্তমানে দেশে নিরাপনের কোনো কার্যক্রম নেই। অন্যদিকে সরকারের ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার অধীনে আরএসসির আওতায় যেসব কারখানার তদারকি চলছিল, সেগুলো বর্তমানে দেখছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি ইউনিট (আইএসইউ)। তাদের অধীনে আছে ৬৫৯টি কারখানা।

ডিআইএফইর কারখানার অগ্রগতি কম

ডিআইএফই–আইএসইউর অধীনে থাকা ৬৭৯টি কারখানার ত্রুটি সংশোধন কাজ হয়েছে মাত্র ৫৪ শতাংশ। মাত্র একটি কারখানা শতভাগ ত্রুটি সংশোধন কাজ শেষ করেছে। তার মানে অধিকাংশ পোশাক কারখানাতেই নিরাপত্তাঝুঁকি রয়ে গেছে।

ডিআইএফইর কারখানা পরিদর্শন কমেছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ডিআইএফইর পরিদর্শকেরা ৪৭ হাজার ৩৬১টি কারখানা পরিদর্শন করেন। পরের বছর এই সংখ্যা ৩ হাজার ৭১৭টি কমে ৪৩ হাজার ৬৪৪টিতে নেমেছে। আবার ২০২০-২১ অর্থবছর ৬ হাজার ২২৭ পোশাক কারখানা পরিদর্শন করা হলেও পরের বছর সেটি কমে ৩ হাজার ৫৬০ হাজার হয়েছে।

সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামীম আহমেদ বলেন, ডিআইএফইর পরিদর্শনের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেছেন, ডিআইএফইর পরিদর্শকেরা চেকলিস্ট সঙ্গে নিয়ে কারখানা পরিদর্শনে যান। তবে অনেক ক্ষেত্রেই চা-নাশতা খাওয়া এবং অর্থ দাবির মাধ্যমেই তাদের পরিদর্শন শেষ হয়।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ডিআইএফইকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। নিরাপত্তা ত্রুটি রয়েছে এমন কারখানার উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ করার মতো আইনি ক্ষমতা তাদের দেওয়া প্রয়োজন।

আরএসসির পরিদর্শন কমেছে

আরএসসির অধীনে থাকা ১ হাজার ৮৮৭ কারখানার ত্রুটি সংশোধন কাজ শেষ হয়েছে ৯১ দশমিক ৩২ শতাংশ। গত এপ্রিল পর্যন্ত ১ হাজার ৩১৭টি কারখানা ত্রুটি সংশোধন করেছে ৯১-১০০ শতাংশ। ত্রুটি সংশোধন কাজ এগোলেও অগ্নিনিরাপত্তায় ব্যবহৃত ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি স্থাপনে কারখানাগুলোর মধ্যে অনাগ্রহ দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে আরএসসির ফলোআপ পরিদর্শন ব্যাপকভাবে কমেছে।

সিপিডির প্রতিবেদন মতে, অ্যাকর্ডের সময়কালে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ত্রুটি সংশোধনের কাজ না করলে সংশ্লিষ্ট কারখানাকে অযোগ্য তালিকায় রাখা হতো। এসব কারখানা তখন ক্রয়াদেশ পেত না। কিন্তু বর্তমানে আরএসসির অযোগ্য তালিকা থেকে ফেরা সহজ।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আরএসসির ফলোআপ পরিদর্শন বাড়াতে হবে। বয়লার পরিদর্শনকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার বিষয়ে পোশাকশ্রমিকদের অভিযোগের সমাধানেও তৎপর হতে হবে। সেফটি কমিটির প্রশিক্ষণের ধরন বদলাতে হবে।

সিপিডির এই গবেষক আরও বলেন, ‘আমরা নতুন করে অ্যাকর্ডকে ফেরাতে বলছি না। অ্যাকর্ড সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে, তাদের সেই সুনাম ধরে রাখা উচিত। আসলে পরিদর্শন কার্যক্রমের মান ও কমপ্লায়েন্স দেখতে চাচ্ছি। কারণ, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বাড়ছে। শ্রমিকের মৃত্যুও শূন্যের কোঠায় নামেনি।’