সক্ষমতা বাড়লে সুবিধা মিলবে

তরুণ উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাপারেলস ইয়ুথ লিডারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএইএলএ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের পোশাক খাতের পথনকশা ২০৩০’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা। গতকাল ঢাকার একটি হোটেলেছবি: প্রথম আলো

চীনের ওপর বেশি হারে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের সুযোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি যত কমবে, বাংলাদেশসহ অনেক দেশ মিলিয়েও তা পূরণ করতে পারবে না। তবে সুযোগটি নিতে গেলে একদিকে বাংলাদেশকে সক্ষমতা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা তুলে ধরতে হবে যে তাদের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ কাজ করছে।

ঢাকার একটি হোটেলে গতকাল শনিবার বাংলাদেশ অ্যাপারেলস ইয়ুথ লিডারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএওয়াইএলএ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের পোশাক খাতের পথনকশা ২০৩০’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। পোশাক খাতের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের তরুণ উদ্যোক্তারা ২০২১ সালে বিএইএলএ গঠন করেন। সংগঠনের সভাপতি আবরার এইচ সায়েম অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে পথনকশা ২০৩০ তুলে ধরে সংগঠনটি।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কুতুবউদ্দিন আহ্‌মেদ মনে করেন, নগদ প্রণোদনা বা ভর্তুকি দিলেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি হারে তুলা আসতে শুরু করবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে প্রতি বেলের দাম ৪ সেন্ট করে বেশি পড়ে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘একজন উদ্ভট মানুষ’ আখ্যা দিয়ে কুতুবউদ্দিন আহ্‌মেদ বলেন, মাথায় যা আসে, তিনি তা-ই করছেন। তবে বাণিজ্য সুনামি থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি দোকান খালি হয়ে যাবে। দেশটির এমন কোনো দোকান নেই, যেখানে চীনা পণ্য নেই। দেশের পোশাক খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন কুতুবউদ্দিন আহ্‌মেদ।

কুতুবউদ্দিন আহ্‌মেদ প্রশ্ন তোলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সম্মেলন হচ্ছে, কখনো কি দেশীয় বিনিয়োগকারীদের কথা শোনার জন্য এমন সম্মেলন হয়েছে?’

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য চলছিল। সবকিছু একটা শৃঙ্খলার মধ্যে ছিল। ট্রাম্প সব ভেঙে দিয়েছেন। এমন বাস্তবতায় যার যত প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থাকবে, সে তত ভালো করবে। এমন একটা সময়ে ট্রাম্প কাজটা করলেন, যখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বের হওয়ার পথে হাঁটছে। এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে বাংলাদেশের প্রতি কারও মায়া বলতে কিছু থাকবে না।

ভিয়েতনামের বড় সুবিধা হচ্ছে, তাদের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আছে—এমন মন্তব্য করে আনোয়ার–উল–আলম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে পিছিয়ে। বাংলাদেশের সস্তা শ্রমের কথা বলা হয়। অথচ ভিয়েতনামের পরিবহন ব্যয় ও ব্যাংকিং সুবিধার সঙ্গে তুলনা করলে খরচ সমানই হয়। তাঁর প্রশ্ন, ‘এনবিআর আমাদের অযথা হয়রানি করে কেন? বন্দরে যেখানে তিন দিনেই পণ্য খালাস হওয়া উচিত, সেখানে ১০ দিন লাগে কেন? এক দশক পর কেন পণ্যমূল্যের এইচএস কোডের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে হঠাৎ পরিবর্তন আনা হলো?’

বিজিএমইএর আরেক সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে দেশটির জনগণের ভোগ কমবে। তাতে কমবে সে দেশের ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ। পাল্টা শুল্ক বেশি আরোপের ফলে চীন যেহেতু বড় ধরনের সংকটে পড়বে, সেহেতু বাংলাদেশের উচিত হবে সুযোগটি কাজে লাগানো।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্যঘাটতি কমানোর সুযোগ আছে। দূরত্ব ও জাহাজ ভাড়া—দুই কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা কম আমদানি হয়। তারপরও একক আমদানিকারক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ।

মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে চীনের রপ্তানি এত কমে যাবে যে সব দেশ মিলেও তা পূরণ করতে পারবে না। সুযোগটি আমরা নিতে পারব কি না, তা অবশ্য ভিন্ন প্রশ্ন।’

বিজিএমইএর প্রশাসক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ২০০৫ সালে মাল্টি ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্ট শেষ হওয়ার পর অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন যে বাংলাদেশের পোশাক খাত শেষ। বাস্তবে তা হয়নি। এখন পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে শুধু কূটনৈতিক চ্যানেল বা দর-কষাকষিই যথেষ্ট নয়। এখন নীতি পদক্ষেপ ও নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার।

পোশাক খাতের প্রায় সব ক্ষেত্রেই তথ্যের ঘাটতি তথা তথ্য সংরক্ষণের দুর্বলতা আছে বলে মনে করেন আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাঁদের কাজে লাগানোর সুযোগ আছে।’ জাতীয় অ্যাপারেলস নীতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি আরএমজি সম্মেলন আয়োজন করা যেতে পারে।

অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহির বলেন, ‘আমাদের যেহেতু কোনো মন্ত্রণালয় নেই, ফলে অ্যাসোসিয়েশন থেকেই যা করার করতে হবে। কিন্তু মনে তো হচ্ছে, আমরা তিন মাসও টিকতে পারব না। কারণ, ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আছেই। ক্রেতাদের কেউ ১০ শতাংশ চাইছেন, কেউ চাইছেন ১০ শতাংশের অর্ধেক।’

শরিফ জহির আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের দেখাতে হবে যে বাণিজ্যঘাটতি কমাতে আমরা কাজ করছি। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি, এটা তোমাদের জন্য বড় সুযোগ।’ তাঁরা বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরো।’