বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বাংলাদেশের কারখানা থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করেছে। করোনাকালের প্রায় দুই বছর এমন ঘটনা ঘটেছে, যখন কিনা কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। আবার করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কারখানাগুলোকে বাড়তি খরচও করতে হয়েছিল ওই সময়।
স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব আবেরডিন ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ট্রেড জাস্টিস চ্যারিটি ট্রান্সফর্ম ট্রেডের যৌথভাবে পরিচালিত জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর—এই সময় জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী এক হাজার তৈরি পোশাক কারখানা অংশ নেয়। এই কারখানাগুলোর মধ্যে ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ ছোট, যাদের কর্মীর সংখ্যা ১ থেকে ১২০ জন। ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ কারখানা মাঝারি, যাদের কর্মীর সংখ্যা ১২১ থেকে ১০০০ হাজার। আর ২২ দশমিক ৫ শতাংশ কারখানা বড়। তাদের কর্মীর সংখ্যা এক হাজারের ওপর।
জরিপে অংশ নেওয়া কারখানাগুলোর ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ নিট পোশাক তৈরি করে। বাকি ৩০ দশমিক ২ শতাংশ কারখানা ওভেন পোশাক প্রস্তুত করে। বাকিগুলো ওভেন ও নিট দুটিই করে। ২০২০ সালের মার্চে কারখানাগুলোয় ৭ লাখ ৮৯ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। তখন করোনার কারণে তিন সপ্তাহের মতো কারখানা বন্ধ ছিল। তারপর শ্রমিক সংখ্যা কমে ৫ লাখ ৮৯ হাজারে নেমে আসে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আবার শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে ৭ লাখ ১৯ হাজার হয়।
জরিপে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের ১ হাজার কারখানা ১ হাজার ১৩৮টি ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্য পোশাক তৈরি করে। বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৮টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের চার বা তার বেশি কারখানা থেকে পোশাক আমদানি করে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—আলদি, আসদা, এইচঅ্যান্ডএম, গ্যাপ, সিঅ্যান্ডএ, এলপিপি, নেক্সট, প্রাইমার্ক, টেসকো, জারা, ইউএস পলো, পিভিএইচ, ম্যাঙ্গো।
জরিপের ফলাফল গতকাল রোববার প্রকাশ করা হয়। জরিপে অংশ নেওয়া কারখানাগুলো ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দাবি করে, করোনা শুরুর পর ২১ মাসে কাঁচামাল ও সরঞ্জামের দাম বেড়েছে। করোনা থেকে কর্মীদের সুরক্ষা দিতে নানামুখী ব্যবস্থা নিতেও খরচ বেড়েছে। তারপরও ৭০ শতাংশ ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের মার্চে যে দামে পোশাক কিনত, এখনো সেই দামই দিচ্ছে। আবার ৯ শতাংশ ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দাম দিয়েছে। পোশাকের একই দাম বা কম দাম, এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে জরিপে অংশ নেওয়া ৭৬ শতাংশ কারখানার।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দাম দেওয়া ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে—আদিত্য বিরলা ফ্যাশন, সিঅ্যান্ডএ, এইচঅ্যান্ডএম, জারা, কিক, লিডল, এলপিপি, নেক্সট। অন্যদিকে ২০২০ সালের মার্চের মতো পোশাকের দাম একই দেওয়া ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে—আদিত্য বিরলা ফ্যাশন, সিঅ্যান্ডএ, এইচঅ্যান্ডএম, আলদি, বেস্ট সেলার, জারা, কিয়াবি, কিক, লিডল, ম্যাঙ্গো, টেসকো, টার্গেট, প্রাইমার্ক, ওটিটিও, এলপিপি ইত্যাদি।
এ ছাড়া জরিপে অংশ নেওয়া ৫০ শতাংশের বেশি পোশাক কারখানা দাবি করেছে, করোনাকালের দুই বছর তাদের ব্যবসায়িক অংশীদার ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান চার ধরনের অন্যায্য কাজ করেছে। তার মধ্যে রয়েছে—ক্রয়াদেশ বাতিল, মূল্যহ্রাস, পোশাক কিনে অর্থ না দেওয়া ও বিলম্বে অর্থ দেওয়া। এ কারণে শ্রমিকের আয় কমেছে, এমনকি চাকরিও হারিয়েছেন অনেকে। তুলনামূলক ছোট ব্র্যান্ডের থেকে বড় ব্র্যান্ডগুলো এসব কাজ বেশি করেছে। যেসব ব্র্যান্ড ১৫ বা তার বেশি কারখানার থেকে পোশাক কেনে, তারা এসব চার অন্যায্যের একটি অন্তত করেছে।
ইউনির্ভাসিটি অব আবেরডিন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনা শুরুর প্রথম দুই বছর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত মজুরি পাননি। পাঁচটির মধ্যে একটি কারখানা শ্রমিকের নূন্যতম মজুরি দিতে সংগ্রাম করেছে। অথচ এই সময় বাংলাদেশের শ্রমিকের শ্রমকে ব্যবহার করে অনেক ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মুনাফা করে নিয়েছে।