আগামী বছর টাইলস রপ্তানিতে যাব

চার ভাইয়ের হাত ধরে ১৯৯১ সালে ঢাকার গ্রিন রোডে ছোট একটি কারখানা দিয়ে যাত্রা শুরু করে ডিবিএল গ্রুপ। পোশাক দিয়ে শুরু হলেও গত ৩২ বছরের পথচলায় টেক্সটাইল, সিরামিক টাইলস, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধসহ নানা খাতের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ডিবিএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ২৭টি। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ৪৩ হাজার কর্মী। বিদায়ী অর্থবছরে গ্রুপটির লেনদেন ছিল প্রায় ৮৭ কোটি মার্কিন ডলার। ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ জব্বার গত শুক্রবার বছরের সেরা ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব শ্রেণিতে বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তার এক দিন আগে গত বৃহস্পতিবার গুলশানে নিজেদের প্রধান কার্যালয়ে নতুন বিনিয়োগ, ব্যবসা পরিস্থিতি, বর্তমানের চ্যালেঞ্জসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন এম এ জব্বার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার

এম এ জব্বার, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিবিএল গ্রুপ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বছর পাঁচেক আগে আপনারা সিরামিকের ব্যবসায় আসেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে ভালো অবস্থানেও পৌঁছাতে পেরেছেন। দেশের টাইলসের বাজারের কতটা নিতে পারল ডিবিএল সিরামিকস?

এম এ জব্বার: আমরা প্রথম থেকেই বিশ্বমানের টাইলস উৎপাদন ও বাজারজাত করার পরিকল্পনা করেছিলাম। বাংলাদেশের টাইলস যেন বিশ্বের যেকোনো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। একই সঙ্গে বিশেষায়িত যেসব টাইলস আমদানি হয়, তা–ও যেন দেশেই উৎপাদন করা যায়। আমরা ইতিমধ্যে বিশ্বমানের বৈচিত্র্যময় টাইলস উৎপাদনে নিজেদের প্রস্তুত করেছি। ফলে দেশের টাইলসের বাজারে আমরা ভালো একটা অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি।

টাইলস রপ্তানির বিষয়টি শুরু থেকেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল। কারণ, রপ্তানিতে গেলেই আপনি বুঝতে পারবেন, কত দূর পৌঁছাতে পেরেছেন। যেহেতু আমরা পণ্যের মানের দিক দিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছেছি সে জন্য রপ্তানি নিয়ে কাজ করছি। ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টাইলস রপ্তানি নিয়ে আলোচনা চলছে। নমুনা আদান–প্রদান হয়েছে। আশা করছি, আগামী বছরই আমরা প্রিমিয়াম টাইলস রপ্তানিতে যেতে পারব।

প্রশ্ন :

আপনারা টাইলসে কি নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন?

এম এ জব্বার: মাওনায় ডিবিএল সিরামিকের কারখানায় প্রতিদিন ৪৫ হাজার বর্গমিটার টাইলস উৎপাদিত হয়। মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে ডিবিএল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে আমরা টাইলসের দ্বিতীয় ইউনিট করার পরিকল্পনা ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছি। সেখানে টাইলসের পাশাপাশি স্যানিটারিওয়্যার উৎপাদন করব। বর্তমানে আমরা অ্যাডভান্সড সিরামিক পণ্য উৎপাদনের জন্য গবেষণা করছি। শুরু থেকেই এটি করার পরিকল্পনা থাকলেও পারিনি। বর্তমানে একটি টিম কাজ করছে। শুরুতে আমরা মূলধনি যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করব। যার বড় অংশই রপ্তানি হবে। কারণ, বাংলাদেশে এসব পণ্যের বাজার খুবই ছোট।

প্রশ্ন :

গত ডিসেম্বরে আপনারা ওষুধের ব্যবসা শুরু করেছেন। বর্তমানে কী ধরনের ওষুধ প্রস্তুত করছেন?

এম এ জব্বার: আমাদের ডিবিএল ফার্মার কারখানা কাশিমপুরে। গত ডিসেম্বরে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ওষুধের বাজারে প্রবেশ করেছি। বর্তমানে আমরা জেনেরিক মেডিসিন তৈরি করছি। সিরামিকের মতো ওষুধও রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। কারণ, রপ্তানি করার জন্য যে মানের ওষুধ দরকার সেটি আমাদের রয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে ইউএসএ-এফডিএ সনদের জন্য কাজ করছি। আশা করছি, দুই বছরের মধ্যে সেটি পেয়ে যাব। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাজ্যের বাজারে রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় সনদের কাজও করছি।

প্রশ্ন :

মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১২টি শিল্পকারখানা করার উদ্যোগ নিয়েছেন আপনারা। সেই বিনিয়োগ কত দূর এগোল?

এম এ জব্বার: শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৬৮ একর জমিতে আমরা ডিবিএল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক করছি। জমি প্রস্তুত। শুরুতে আমরা সুতা, সিরামিক ও বস্ত্র খাতের প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদনের জন্য তিনটি কারখানা করব। ইতিমধ্যে জিন্নাত টেক্সটাইলের কারখানার নির্মাণকাজ বেশ এগিয়ে গেছে। আগামী এপ্রিলে এটি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে দিনে ৩৫ টন সুতা উৎপাদিত হবে।

প্রশ্ন :

সম্ভাবনাময় খাত সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে আপনার নিজের অনেক স্বপ্ন। আপনাদের নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর পাঁচ বছর অতিক্রম করেছে। কত দূর এগোতে পারল এখন পর্যন্ত?

এম এ জব্বার: ২০১৭ সালে আমরা ২০ জন নিয়ে শুরু করেছিলাম। বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠানে শতাধিক প্রকৌশলী কাজ করছেন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ছয়টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাতে প্রায় ৫০০ প্রকৌশলী কাজ করছেন। সম্ভাবনাময় সেমিকন্ডাক্টর খাতের বৈশ্বিক বাজার ৬০ হাজার কোটি ডলার, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ১ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছে যাবে। সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানি করে ভিয়েতনাম ৬০০ কোটি, মালয়েশিয়া ২ হাজার ৭০০ কোটি ও ভারত ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার আয় করে। আমাদের রপ্তানি কম হলেও আমরা খুবই আশাবাদী। একই সঙ্গে আমাদের আত্মবিশ্বাসও অনেক। এই খাতে আমাদের মূল কাঁচামাল অর্থাৎ প্রকৌশলী। তাদের শুধু এই শিল্পের জন্য তৈরি করে নিতে হবে। এ জন্য দরকার নীতিসহায়তা। যদিও বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হওয়া সেমিকন্ডাক্টর খাত নিয়ে নীতিনির্ধারকের মধ্যে কোনো আলোচনা নেই।

প্রশ্ন :

করোনার পর খুব ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তৈরি পোশাক রপ্তানি। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সম্প্রতি আবার ক্রয়াদেশ কমছে। তাতে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। সব মিলিয়ে পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

এম এ জব্বার: আমি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত নিয়ে খুবই আশাবাদী। এই ব্যবসা নিয়ে আমি খুব বেশি চিন্তিত নই, কারণ আমরা ইতিমধ্যে মহাসড়কে আছি। আমাদের সম্ভাবনা অনেক। সুযোগ নেওয়ার সক্ষমতাও আছে। আমরা কতটুকু নিতে পারব, সেটাই এখন প্রশ্ন। আমাদের প্রতিযোগী অনেক দেশের সম্ভাবনাও নেই। সক্ষমতাও নেই। আমাদের কিন্তু দুটোই আছে। বর্তমানে পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে আমাদের উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারকের ওপর।

আমাদের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের এখন হাই ভ্যালু আইটেম বা বেশি মূল্য সংযোজিত হয় এমন পোশাক উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের পোশাকের জন্য আমাদের দরজায় টোকা দিচ্ছে। আমরা মতে, পোশাকশিল্পে পেশাদারত্বের অভাব আছে। করপোরেট সুশাসন, নীতি ও স্বচ্ছতারও ঘাটতি দেখি। এই জায়গাগুলো ঠিক থাকলে কোনো সমস্যা ছিল না। তবে উদ্যোক্তাদের সবাই এসবের জন্য প্রস্তুত না। সে কারণে দেখবেন, পাঁচ বছর পর অনেকেই টিকে থাকবে না। নতুন নতুন কোম্পানি আসবে। সোজাসাপ্টা কথা হচ্ছে, নব্বইয়ের দশকে যেভাবে ব্যবসা করেছি, সেভাবে আর এগোনো সম্ভব না। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

প্রশ্ন :

ডলার-সংকট ও গ্যাস-বিদ্যুতের অপর্যাপ্ততার কারণে দেশের অর্থনীতি কিছুটা চাপের মধ্যে রয়েছে। আপনারা কতটা ভুক্তভোগী?

এম এ জব্বার: বর্তমানে আমাদের প্রধান সমস্যা বিদ্যুৎ–সংকট। এ জন্য আমাদের সব কটি শিল্পকারখানা ভুগছে। তবে সিরামিকে বেশি সমস্যা হচ্ছে। অনেক টাইলস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে অন্য অনেক কারখানার মতো আমাদের টাইলস উৎপাদন ৪০-৫০ শতাংশ কমে গেছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে টাইলসের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। পণ্যের দামও সমন্বয় করতে হবে। অথচ বাড়তি দামের জন্য বাজার প্রস্তুত নয়। ফলে হুট করে দাম বাড়ানো কঠিন। ইতিমধ্যে টাইলসের বেচাবিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

প্রশ্ন :

দুই মাস ধরে জ্বালানি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস অনুসন্ধানসহ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলেছেন অনেক ব্যবসায়ী নেতা। আপনার মতামত কী?

এম এ জব্বার: আমরা প্যাশনেড (নিবেদিত) ইনভেস্টর (বিনিয়োগকারী)। আমরা প্যাশনেড রাজনীতিবিদ চাই। এই দুইটা বিষয় একসঙ্গে চলতে হবে। এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।