শিল্পকারখানা খুলেছে, সংকট কাঁচামালের

শিল্পকারখানা খুলতে শুরু করেছে। ‘ফাইল ছবি

কারফিউর মধ্যে টানা তিন দিন বন্ধ থাকার পর চট্টগ্রামের অধিকাংশ শিল্পকারখানাসহ অন্যান্য এলাকার অল্প কিছু শিল্পকারখানা গতকাল মঙ্গলবার চালু হয়েছে। তবে আজ বুধবার থেকে সারা দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা চালু হয়েছে। ইস্পাতসহ কিছু কারখানার মালিক জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে বন্দর থেকে কাঁচামাল খালাস না হওয়ায় অনেকে পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছেন না। কোনো কোনো কারখানা কাঁচামাল না পেলে কয়েক দিন পর আর কারখানা চালু রাখতে পারবে না বলেও জানান।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে গতকাল রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে বৈঠক করেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান, সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ, সিদ্দিকুর রহমান ও আবদুস সালাম মুর্শেদী, বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রমুখ।

বৈঠক শেষে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে জানান, আজ বুধবার থেকে তৈরি পোশাক কারখানার পাশাপাশি সংযোগশিল্পের কারখানা খুলবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর শ্রমিকদের প্রাতিষ্ঠানিক আইডি কার্ড (পরিচয়পত্র) সঙ্গে রাখতে বলা হয়েছে। এই আইডি কার্ড কারফিউ পাস হিসেবে কাজ করবে।

এদিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেড ছাড়া অন্যান্য এলাকার অধিকাংশ শিল্পকারখানা গতকাল চালু হয়েছে। এর বাইরে ময়মনসিংহের ভালুকা, মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকার কিছু কারখানা সীমিত আকারে উৎপাদনে ফিরেছে। যদিও গাজীপুর ও ভালুকার কিছু কারখানা কর্তৃপক্ষ উৎপাদন শুরুর প্রস্তুতি নিলেও প্রশাসনের বাধার মুখে বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার নিজ কার্যালয়ে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রয়োজনীয় সবকিছু করার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘আপনাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, আমরা তাই করব।’

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময়ের পর ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ওই দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে চট্টগ্রামের কারখানা চালুর বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার কারখানা খোলার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরেকটু পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

শিক্ষার্থীদের কোট সংস্কার আন্দোলন শুরুতে শান্তিপূর্ণ থাকলেও গত সপ্তাহে সহিংসতা শুরু হয়। তাতে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আমদানি ও রপ্তানিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়। শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ জারির পর অধিকাংশ শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

চট্টগ্রামে অনেক কারখানা চালু

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও চট্টগ্রাম ইপিজেডের বাইরের সিংহভাগ শিল্পকারখানা গতকাল উৎপাদন শুরু করেছে। আনোয়ারায় বেসরকারি কোরিয়ান ইপিজেডের কারখানাও খুলেছে। তবে শ্রমিকের উপস্থিতি ছিল কিছুটা কম।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ সড়কে ইউনি গার্মেন্টসে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকদের সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কারখানাটিতে কাজ করেন। এর মধ্যে গতকাল ১ হাজার ৪০০ শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন।

কারখানার মহাব্যবস্থাপক এম কে নাসের প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববার দেড় লাখ পিছ তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য জাহাজে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। কারখানায় গাড়িও আনা হয়। তবে সহিংস পরিস্থিতির কারণে পণ্য রপ্তানি করা যায়নি। গত সোমবারও একটি চালান রপ্তানি করা যায়নি। বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছে না।

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ইপিজেডের বাইরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট, বায়েজিদ, দেওয়ানহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় ৯০ শতাংশ কারখানা গতকাল থেকে চালু হয়েছে।

প্রথম আলোর আনোয়ারা প্রতিনিধি জানান, কোরিয়ান ইপিজেডের ৩৮ কারখানা গতকাল সকাল থেকে উৎপাদন শুরু করে। এসব কারখানায় কাজ করেন প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক। হঠাৎ করে কারখানা চালুর সিদ্ধান্তে শ্রমিকেরা বিপাকে পড়েন। যানবাহন–সংকটের মধ্যেই দূরদূরান্ত থেকে কাজে যোগ দিতে আসেন শ্রমিকেরা।
কোরিয়ান ইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থায় কারখানাগুলো চালু করা হয়েছে। প্রথম দিনে কারখানার প্রায় ৯০ শতাংশ শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন।’

এদিকে সীতাকুণ্ডের ইস্পাত কারখানাগুলোও গতকাল থেকে উৎপাদনে ফিরেছে। এমন তথ্য দিয়ে জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জিপিএইচের পাশাপাশি সীতাকুণ্ড এলাকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও উৎপাদনে ফিরেছে। পণ্য সরবরাহে স্থানীয় প্রশাসন সহযোগিতা করছে। তিনি জানান, মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে তাঁদের মালিকানাধীন ক্রাউন সিমেন্ট কারখানায় সীমিত পরিসরে উৎপাদন হচ্ছে। যদিও সিমেন্ট সরবরাহ কয়েক দিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

আমরা গাজীপুরের কারখানা চালু করার বিষয়ে প্রশাসন থেকে অনুমতি পাইনি। ভালুকাতে আমরা ৩০-৪০ শতাংশ সক্ষমতায় কারখানা চালু করতে চেয়েছিলাম। তবে স্থানীয় প্রশাসন কারখানা না খুলতে পরামর্শ দিলে আমরা সিদ্ধান্ত বদলাই।’
শোভন ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ

অন্য এলাকার কারখানার চিত্র

ময়মনসিংহের ভালুকা ও গাজীপুরের টঙ্গীতে ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের চামড়াবিহীন জুতা ও প্লাস্টিক পণ্যের কারখানা গতকাল চালু হয়েছে। তবে কাঁচামালের অভাবে প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে আমাদের শতাধিক কনটেইনার কাঁচামাল আটকে আছে। কাঁচামাল না এলে ভালুকার জুতার কারখানার উৎপাদন চার-পাঁচ দিনের বেশি সচল রাখা যাবে না। অন্যদিকে কাঁচামালের অভাবে টঙ্গীর প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন কারখানা মাত্র ১৫ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতায় চালাতে হচ্ছে।

এদিকে ভালুকায় স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ক্রাউন ওয়্যারস নামের কারখানাটি গতকাল সীমিত আকারে চালু করতে চেয়েছিল। তবে স্থানীয় প্রশাসন অনুমতি না দেওয়ায় তারা উৎপাদন শুরু করতে পারেনি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ‘আমরা গাজীপুরের কারখানা চালু করার বিষয়ে প্রশাসন থেকে অনুমতি পাইনি। ভালুকাতে আমরা ৩০-৪০ শতাংশ সক্ষমতায় কারখানা চালু করতে চেয়েছিলাম। তবে স্থানীয় প্রশাসন কারখানা না খুলতে পরামর্শ দিলে আমরা সিদ্ধান্ত বদলাই।’
এ বিষয়ে ভালুকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী নূর খানের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা অ্যাপারেলস ও প্লামি ফ্যাশনস গতকাল সীমিত আকারে নিটিং ও ডাইং ইউনিট চালু করেছে। এ ছাড়া জেলার রূপগঞ্জের ইন্টিমেড স্পিনিং, নান্নু স্পিনিং ও ভাই ভাই স্পিনিং মিল সীমিত আকারে সুতা উৎপাদন করছে। যদিও গাজীপুরের চন্দ্রা মোড়ের টাওয়েল টেক্সের মতো অনেক কারখানা উৎপাদন শুরু করতে প্রশাসনের অনুমতি পায়নি।

বিটিএমএ নিজেদের নিরাপত্তায় বস্ত্রকলগুলো চালু করতে চাইলেও গাজীপুর প্রশাসন তা করতে দেয়নি।
ফাইল ছবি

জানতে চাইলে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সহসভাপতি ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিজেদের নিরাপত্তায় বস্ত্রকলগুলো চালু করতে চেয়েছিলাম। তবে গাজীপুর প্রশাসন চালু করতে দেয়নি। তারা বলেছে, কারখানা চালু করলে তারা মামলা দেবে। অন্য এলাকার বস্ত্রকলগুলো উৎপাদন শুরু করেছে কি না, সে সম্পর্কে আমার কাছে তথ্য নেই।’

এদিকে ঢাকার কোনাপাড়া এলাকার ইস্পাত কারখানাগুলো সীমিত আকারে উৎপাদন শুরু করেছে। তাদের মধ্যে শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম বলেন, ‘কারখানায় উৎপাদন শুরু করলেও দুশ্চিন্তায় আছি। কারণ, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কাঁচামাল আসছে না। কাঁচামাল না এলে দু-তিন দিনের বেশি কারখানা চালানো যাবে না।’