শিল্পের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা, অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদফাইল ছবি

দেশের শিল্পকারখানার নিরাপত্তা ও এই খাতে চাঁদাবাজি নিয়ে আবারও উদ্বেগ জানিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশি পণ্যের বিদেশি ক্রেতাদের এখন মূল উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা। তাই দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিরাজমান অন্যান্য জটিলতা নিরসনেও শিগগিরই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে বিদেশি ক্রেতারা বিকল্প গন্তব্য খুঁজবেন।

অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এক বৈঠকে এ কথা বলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের নেতারা। আজ মঙ্গলবার উপদেষ্টার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে আইসিসি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান।

বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন আইসিসি বাংলাদেশের সহসভাপতি এ কে আজাদ ও নাসের এজাজ বিজয়; সদস্য তপন চৌধুরী, মীর নাসির হোসেন, মোহাম্মদ হাতেম; বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়ার প্রধান জিয়াউর রহমান এবং মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার ব্র্যান্ডের এ দেশীয় পরিচালক স্বপ্না ভৌমিক।

বৈঠক শেষে উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুনির্দিষ্ট কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এগুলো নতুন নয়। আগে অনেক সময় বিষয়গুলো অবহেলা করা হয়েছে। তবে আমরা এগুলোর সমাধানে উদ্যোগ নেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘বৈঠকে বিদেশি ক্রেতা প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা ও আর্থিক খাতে নিরাপত্তার বিষয়ে তাঁদের আশ্বস্ত করেছি। তাঁদের বলেছি, বাংলাদেশে একটি নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে। কারখানার প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা আমরা দেব।’

জানা গেছে, বৈঠকে আইসিসির নেতারা অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টার কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি; ব্যাংক, এনবিআর ও জ্বালানি খাতের সংস্কার; তথ্যপ্রযুক্তি খাত শক্তিশালীকরণ; বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি; তথ্য-উপাত্তে স্বচ্ছতা; বাণিজ্য সংগঠনের সংস্কারসহ ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন।

আইসিসি বাংলাদেশের দাবি
* দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাংক, এনবিআর ও জ্বালানি খাতের সংস্কার; তথ্যপ্রযুক্তি খাত শক্তিশালীকরণ; তথ্য-উপাত্তে স্বচ্ছতা, বাণিজ্য সংগঠনের সংস্কারসহ ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন তাঁরা।
বিজিএমইএর দাবি
* পোশাকশিল্পের নেতারা বেশ কিছু নীতিসহায়তা দাবি করেছেন।
* তাঁরা সহজ শর্তে ১,৮০০-১,৯০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছেন।
* পরবর্তী তিন মাস গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করার দাবি।  

অন্যদিকে বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধিরা জানান, কর্মীদের ওয়ার্ক পারমিট ও পরিবারের ভিসা পেতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে।

বৈঠক শেষে এ কে আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিমানবন্দর থেকে পোশাকের নমুনা সংগ্রহ করতে ৭ থেকে ১০ দিন লাগে। চট্টগ্রাম বন্দরেও কনটেইনারের জট চলছে। এই নেতিবাচক বিষয়গুলো সমাধান করতে না পারলে বিদেশি ক্রেতারা বিকল্প চিন্তা করবেন। অন্য কোনো দেশে ব্যবসা সরিয়ে নেবেন। এ কথা তাঁরা এখানে বলেননি; তবে আমাদের (ব্যবসায়ীদের) কাছে বলেছেন।’

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ও অন্যান্য সমস্যার সমাধানে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান এ কে আজাদ। তিনি বলেন, ‘আমরা শুনেছি, বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) সুবিধা তুলে নেবে। এ ছাড়া নগদ প্রণোদনাও যেটুকু আছে, সেটুকু প্রত্যাহার করা হবে। এসব যেন না করা হয়, এ জন্য আমরা উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছি।’

কারখানা চালাতে অসুবিধা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে এ কে আজাদ বলেন, ‘কিছু কিছু জায়গায় প্রচুর চাঁদাবাজি হচ্ছে। চাঁদাবাজির বিষয়টিও আমরা উপদেষ্টার নজরে এনেছি। উনি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ হয়েছে। এখন সবাই নির্বাচন দাবি করছেন। এখানে সংস্কার না করে নির্বাচন দিয়ে দিলে আগের মতোই হবে। এ জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার কমিটি করতে আমরা উপদেষ্টাকে প্রস্তাব দিয়েছি। প্রয়োজনীয় সংস্কার হলে বাণিজ্য সংগঠনে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আসবে।’

নেতারা জানান, ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে সমস্যা পড়ছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে, ইসলামি ছয়টি ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে গেলে মার্জিন চাওয়া হচ্ছে। বিষয়টি উপদেষ্টাকে জানালে তিনি গভর্নর ও অর্থসচিবের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থা পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। চলমান বন্যায় কাঁচামাল আসতে পারেনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ে শত শত কনটেইনার আটকে আছে। সেখানে নিরাপত্তাহীনতাও রয়েছে। পানগাঁও বন্দর সচল করা জরুরি। নৌপথে এই বন্দরে যদি কাঁচামাল আনা যায়, তাহলে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে পারে।

বিজিএমইএ চায় ১,৯০০ কোটি টাকা

রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের এক মাসের মজুরি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সহজ শর্তে ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ দাবি করেছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা। পাশাপাশি তাঁরা বেশ কিছু নীতিসহায়তাও চেয়েছেন।

আজ মঙ্গলবার আইসিসি বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের আগে শেরেবাংলা নগরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কার্যালয়েই অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বিজিএমইএর প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বিজিএমইএর প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংগঠনের নতুন সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান ও এস এম ফজলুল হক; বর্তমান পর্ষদের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব, সহসভাপতি নাসির উদ্দিন, মিরান আলী, আসিফ আশরাফ প্রমুখ।

বৈঠক শেষে বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেকগুলো কারণেই আমরা শ্রমিকদের এক মাসের মজুরির সমপরিমাণ অর্থঋণ হিসেবে চেয়েছি। আমরা এই ঋণ এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করে দেব।’

একই সঙ্গে বিজিএমইএর নেতারা ঋণের কিস্তি পরিশোধেও সুবিধা চেয়েছেন। আগে কোনো প্রতিষ্ঠান ছয়টি কিস্তি পরিশোধ না করলে ঋণখেলাপি হতো। বর্তমানে তিনটি কিস্তি পরিশোধ না করলে খেলাপি ঘোষণা করা হয়। সুবিধাটি আগের মতো করার দাবি জানান তাঁরা। একই সঙ্গে শিল্পকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য পরবর্তী তিন মাস গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করার দাবিও জানান বিজিএমইএর নেতারা।