সিন্ডিকেটসহ সাত কারণে দেশে কাঁচা চামড়ার দাম কম, বিসিকের প্রতিবেদন
দেশের চামড়া খাতের প্রধান সমস্যা কমপ্লায়েন্সের অভাব। কর্মীদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চামড়া খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে রয়েছে।
দেশে এক দশক ধরে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কম। চলতি বছর কোরবানি হওয়া গরুর কাঁচা চামড়ার দাম অবশ্য গতবারের চেয়ে পিসপ্রতি ৫০-১০০ টাকা বেড়েছে। তারপরও একেকটি চামড়া সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে কমপক্ষে ২৭৫-৩০০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কম থাকার পেছনে সাতটি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা। কারণগুলো হচ্ছে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণে সরবরাহ; লবণের মূল্যবৃদ্ধি, ভ্যানভাড়া ও ঈদ বোনাস; ক্রেতার সংখ্যা হ্রাস পাওয়া ও বিপুল সংগ্রহ; ব্যবসায়ীদের তহবিল সংকট; ট্যানারিমালিকেরা সঠিকভাবে অর্থ দেন না; ট্যানারিমালিকদের সিন্ডিকেট এবং বাজার সিন্ডিকেট।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) গত মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এই গবেষণার জন্য আট বিভাগের আট জেলার ২২০ জন কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীসহ কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি এবং চামড়া পণ্য ও জুতা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের মোট ৪০৩ জনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
চামড়াশিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। এতে মূল্য সংযোজন বেশি। তবে তা এখনো কাজে লাগানো যায়নি। তাই হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য পথনকশা তৈরি করে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিতে হবে।আবু ইউসুফ, নির্বাহী পরিচালক, র্যাপিড।
এ বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৫৫-৬০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়, যা গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা। যদিও বিসিকের গবেষণায় অংশ নেওয়া কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের ৬০ শতাংশের মতে, সরকার নির্ধারিত চামড়ার দাম বাড়ানো দরকার। তাঁরা প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ৫০-৭০ টাকা হওয়াকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন।
গবেষণায় উঠে এসেছে, কাঁচা চামড়ার সঠিক মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতে সরকারিভাবে সিন্ডিকেট বন্ধ করার পাশাপাশি লবণের দাম হ্রাস, লেনদেন ব্যবস্থা তদারকি, ট্যানারিমালিকদের যথাসময়ে অর্থ দিতে বাধ্য করা, সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি কার্যকর করা এবং ট্যানারিগুলোর মানোন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ৬২ শতাংশ কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ী মনে করেন, চামড়া খাতে সরকারের প্রণোদনা যথেষ্ট নয়। প্রণোদনা থাকলে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হতো।
ব্যবসা ভালো তিন মাস
পবিত্র ঈদুল আজহা–পরবর্তী তিন মাসে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেন কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা। সাড়ে ৬৪ শতাংশ কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ী এই সময়ে মাসে গড়ে ২০ লাখ টাকার কেনাবেচা করেন। ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশের ব্যবসা হয় ২০ লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৮ শতাংশ ব্যবসায়ী ৪০ লাখ থেকে ৮০ লাখ টাকার কাঁচা চামড়া কেনাবেচা করেন। ১ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করেন ৫ শতাংশ ব্যবসায়ী।
বছরের অন্য সময়ে অধিকাংশ অর্থাৎ ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীর মাসে গড় লেনদেন হয় ১০ লাখ টাকার কম। ৬ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবসায়ী ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকার চামড়া কেনাবেচা করেন। আর ২ দশমিক ৭ শতাংশের ব্যবসা থাকে ২০ লাখ ৩০ লাখ টাকার মধ্যে। ১ দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মাসে ৪০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকার কাঁচা চামড়া কেনাবেচা করতে পারেন।
ট্যানারির বিনিয়োগ ২০ কোটি টাকা
সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ২৩০টির বেশি ট্যানারি রয়েছে। এর মধ্যে আধুনিক ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ৩০টির মতো। ৮৫ শতাংশ ট্যানারির অবস্থান ঢাকায়। অধিকাংশ বা ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ ট্যানারির বিনিয়োগ ২১ কোটি টাকার কম। এ ছাড়া ১৩ শতাংশ ট্যানারিতে ২১ কোটি থেকে ৪০ কোটি টাকা এবং ৩ শতাংশ ট্যানারিতে ১০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। এসব বিনিয়োগের প্রায় অর্ধেকই উদ্যোক্তাদের নিজস্ব বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্যানারিগুলো যেসব চামড়া রপ্তানি করছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্রাস্ট চামড়া, ৩৭ শতাংশ। এ ছাড়া ২৩ শতাংশ ফিনিশড চামড়া, ৩৪ শতাংশ ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়ার মিশ্রণ এবং ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ ওয়েট ব্লু চামড়া। তবে ৭২ শতাংশ ট্যানারির চামড়া বিশ্বের প্রসিদ্ধ কোনো ব্র্যান্ড নেয় না।
কম সুদের ঋণ পাচ্ছেন না অনেকে
সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরের পরিবেশদূষণের কারণে সেখানকার ট্যানারিগুলো চামড়া রপ্তানিতে ভালো দাম পাচ্ছে না। এদিকে কমপ্লায়েন্স বা উন্নত কর্মপরিবেশ না থাকায় শিল্পনগরের বাইরে থাকা অধিকাংশ চামড়া পণ্য ও জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে কম সুদের ঋণ পাচ্ছে না। গবেষণা–জরিপে অংশ নেওয়া ১২৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮৬ শতাংশই জানিয়েছে, কমপ্লায়েন্সের অভাবে এই ঋণ পাচ্ছে না তারা।
জরিপে অংশ নেওয়া ৫৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই চলছে নিজস্ব অর্থায়নে। বাকি ৪৩ শতাংশ ব্যাংকঋণ পেয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৭ শতাংশের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ লাখ টাকার কম। ২০ শতাংশ কোম্পানির বিনিয়োগ ১ কোটি টাকার বেশি, যেগুলো মূলত বড় কোম্পানি।
দেশে গত ৬ বছরে প্রায় ১২০টি নতুন কারখানা হয়েছে। এ ছাড়া অনেক আন্তর্জাতিক বায়িং হাউস জুতা উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করেছে। আর ফিলা, ডিচম্যান, টিম্বারল্যান্ড, অ্যালডো, এইচঅ্যান্ডএম, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, এস অলিভার, উলভারিনসহ বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে চামড়া পণ্য ও জুতা আমদানি করে থাকে।
বিসিকের প্রতিবেদনমতে, কমপ্লায়েন্স বা উন্নত কর্মপরিবেশ না থাকাই হলো দেশের চামড়া খাতের প্রধান সমস্যা। কর্মীদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া কাঁচা চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা ও ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, সিইটিপির অপর্যাপ্ত সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক বাজারের ফ্যাশন ও বিপণনের ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার ঘাটতি, ফিনিশড চামড়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঘাটতি, সাভারের চামড়াশিল্প নগরের সীমিত সক্ষমতা, সংযোগ শিল্পের অভাবসহ বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে চামড়াশিল্পে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ বলেন, চামড়াশিল্পের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ দরকার। এই কর্তৃপক্ষ শুধু চামড়া খাতের উন্নয়ন নিয়েই কাজ করবে। প্রধানমন্ত্রীও চামড়া খাতের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আবু ইউসুফ আরও বলেন, খাতটি খুবই সম্ভাবনাময়। এতে মূল্য সংযোজন বেশি। তবে তা এখনো কাজ লাগানো যায়নি। তাই হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য পথনকশা তৈরি করে তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিতে হবে। চামড়াশিল্প নগরের ১৫-২০টি ট্যানারি সত্যিকার অর্থেই এলডব্লিউজি (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ) সনদ নিতে চায়। সুতরাং সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে কাজ করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।