রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশের শিল্প খাতে বেশ কিছু ইতিবাচক অর্জন হয়েছে। তবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এখনো অনেক দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জ আছে। দুর্ঘটনার বিচার না হওয়া, বিদ্যমান আইন কার্যকর না হওয়া, কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন না থাকা, দর-কষাকষির ক্ষেত্র কম থাকা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা—এসব কারণে দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জ।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরির অর্জন ও চ্যালেঞ্জ: রানা প্লাজা–পরবর্তী উদ্যোগসমূহের অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আলোচনা সভা আয়োজন করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ওই দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৫ শ্রমিক নিহত হন। সেই দুঃখজনক ঘটনার ১১ বছর পূর্ণ হবে আগামীকাল বুধবার। এ উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করে বিলস।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে সমন্বিত প্রচেষ্টার সঙ্গে জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া দুর্ঘটনা–সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান সব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা, কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা ও দর-কষাকষির পরিসর তৈরি করতে হবে।
বিলসের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান সিরাজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইন্ডাস্ট্রি-অল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ বাদল, গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়কারী নইমুল আহসান জুয়েল, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া, বিলসের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসাইন, আইএলওর প্রতিনিধি মউরাইস লেন ব্রোকস প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ।
স্বাগত বক্তব্যে বিলসের মহাসচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের ঘটনা শুধু দুর্ঘটনা বলে মানতে আমরা নারাজ; শিল্প পরিদর্শনের দুর্বলতা ও তদারকির ঘাটতির কারণে এটা হয়েছে। রানা প্লাজার ঘটনার পর বেশ কিছু ইতিবাচক অর্জন হয়েছে, যেমন বেশ কিছু আইনে পরিবর্তন এসেছে, সরকারি পরিদপ্তর ও অধিদপ্তর হয়েছে, নতুন অনেক ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়েছে। তবে নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরির জন্য এগুলোর কোনোটাই পর্যাপ্ত নয়। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত অনেক শ্রমিক ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ চিকিৎসা পাননি। অনেক আহত শ্রমিক পরবর্তী সময়ে আর কাজে ফিরতে পারেননি।’
বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা অন্যান্য শিল্প খাতে কাজে লাগানো হয়নি। সে জন্য চট্টগ্রামে কনটেইনার ডিপো, নারায়ণগঞ্জে হাশেম ফুডের কারখানা, নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডে ক্ষতিপূরণ পাননি। অনেক দুর্ঘটনার পরে মামলা নেওয়া হয়নি; দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা সেবা পাননি আহত শ্রমিকেরা।
গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সমন্বয়কারী নইমুল আহসান জুয়েল বলেন, নিরাপদ কর্মক্ষেত্রের জন্য বিদ্যমান আইনের বিধিগুলো ঠিকভাবে মানা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা আছে, যেমন ফায়ার সার্ভিসের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নেই। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মালিককে নোটিশ দেওয়া পর্যন্তই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ।
কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও নিয়ম মানার বিকল্প নেই বলে জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, স্বল্পসংখ্যক ফায়ার ফাইটার দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন। সে জন্য তিনি দুর্ঘটনা রোধে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ, জাতীয়ভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরামর্শ দেন।
ইন্ডাস্ট্রি-অল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ বাদল বলেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া। রানা প্লাজার পরে কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও তৈরি পোশাক খাতের বাইরে দুর্ঘটনা ঘটছেই। সে জন্য তিনি শ্রমিকদের ঝুঁকিবিমা ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা এবং ক্রেতাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করায় জোর দেন।
শিল্পকারখানার শ্রমিকদের সমন্বিত স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার পরামর্শ দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম রেজাউল হক। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ দিন দিন কমছে; এর কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
বিলসের ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসাইন বলেন, শ্রমিকদের কার্যকর ট্রেড ইউনিয়ন না থাকা বড় সমস্যা। রানা প্লাজার ঘটনার পর মালিকদের অনুগত লোক দিয়ে নামকাওয়াস্তে অনেক ট্রেড ইউনিয়ন করা হয়েছে। ফলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য ইস্যুতে কার্যকরভাবে দর–কষাকষির জায়গা তৈরি হয়নি। সংগঠন করার স্বাধীনতা ও দর-কষাকষির সুযোগ না থাকলে কোনো অর্জনই টেকসই হবে না।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আইএলওর প্রতিনিধি মউরাইস লেন ব্রোকস বলেন, আগের চেয়ে কর্মপরিবেশ এখন বেশি নিরাপদ। সরকারও অনেক নীতি ও কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যদিও এর বেশির ভাগ তৈরি পোশাক খাতে। এখন অন্যান্য খাত ও নিরাপত্তায় নজর দিতে হবে। শ্রম অধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগও দিতে হবে।