এক চুমুকেই মান যাচাই
মান যাচাইয়ের কথা এলেই চোখে ভেসে ওঠে যন্ত্র বা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা। ফলাফল হাতে আসতেও অপেক্ষা। তবে চায়ের গুণগত মান যাচাই প্রচলিত ধারণা থেকে ভিন্ন। পুরো চা পান না করে শুধু এক চুমুকেই হয় এই পানীয়ের মান যাচাই। ফলাফলও হয় সঙ্গে সঙ্গে। এ কাজটি করেন টি টেস্টার (চায়ের মান পরীক্ষক)।
বাগানে উৎপাদিত চা বেশ কটি ধাপ পেরিয়ে আসে টি টেস্টারের টেবিলে। যেমন বাগানের সবুজ পাতা কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করার পর কালো চায়ে রূপ নেয়। সেই চা পাঠানো হয় গুদামে। এরপর নিলামে তোলার পালা। বাগান ও লট অনুসারে তালিকা (ক্যাটালগ) প্রস্তুত করে চায়ের নির্ধারিত ক্রেতাদের সেই নমুনা পাঠিয়ে দেয়।
নমুনা হাতে পাওয়ার পর প্রথমে চায়ের আকার কেমন এবং কোন ব্র্যান্ডের চা প্রস্তুতের জন্য উপযুক্ত, তা বাছাই করা হয়। এরপর টি টেস্টিংয়ের লম্বা কাপে নির্দিষ্ট পরিমাণ চা রেখে তাতে ফুটন্ত পানি ঢেলে কাপকে ঢেকে রাখা হয়। চার থেকে পাঁচ মিনিট পর ঢাকনা খুলে গোলাকৃতির কাপে ঢেলে চায়ের লিকার পরীক্ষা করা হয়। চায়ের রং, গন্ধ ও সুবাস বের হওয়ার জন্য চার থেকে পাঁচ মিনিট আদর্শ সময় বলে ধরে নেওয়া হয়।
পরীক্ষকের টেবিলে সারি সারি কাপে রাখা হয় চা। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে শীর্ষস্থানীয় চা কোম্পানি ইস্পাহানি টি লিমিটেডের কার্যালয়ে দেখা যায়, মান যাচাই কক্ষে কাপ থেকে এক চামচ চা তুলে মুখে নিয়ে সশব্দে চুমুক দিলেন পরীক্ষক। অনেকটা চেকে দেখার মতো। মুখে নিলেন কিন্তু পান করলেন না, যাচাইয়ের পর ফেলে দিলেন পাশের জারে। মুখ খালি হতেই সাংকেতিক ভাষায় চায়ের মান বলে যাচ্ছেন তিনি। সামনে রাখা ক্যাটালগে কলম দিয়ে দ্রুত তা টুকে নিচ্ছেন আরেকজন। দুটি বড় টেবিলে রাখা শতাধিক কাপের চায়ের মান যাচাই হয়ে গেল অল্প সময়ে।
মান যাচাই শেষে কথা হয় ইস্পাহানি টি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক শাহ মঈনুদ্দিন হাসানের সঙ্গে। প্রায় ২৭ বছর ধরে তিনি টি টেস্টার হিসেবে কাজ করছেন। কীভাবে এত দ্রুত চায়ের স্বাদ ও মান যাচাই করেন, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে, নিলাম থেকে চা কেনার জন্য সপ্তাহে চার–পাঁচ দিন এই মান যাচাই চলে। এ সময়ে তিন থেকে চার হাজার নমুনার চা যাচাই করতে হয়। চায়ের গুণগত মান যাচাই করে বোঝার জন্য দীর্ঘ সময় ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাই বড় সম্বল। এই অভিজ্ঞতার কারণে দ্রুত চায়ের মান যাচাই করা যায়।
নিলামে প্রতিযোগিতা করে চা কেনেন টি টেস্টাররাই। নিলাম পরিচালনাকারীরা ক্যাটালগের লট নম্বর ঘোষণার সঙ্গেই টি টেস্টারদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে চায়ের মান। কেনার পর চা কোম্পানিগুলো যখন নিজেদের ব্র্যান্ডের নামে চা বাজারজাত করে, সেগুলো ব্লেন্ডিং (মিশ্রণ) করতে হয়। এই কাজেরও দায়িত্ব টি টেস্টারদের হাতে। নানা রকমের গ্রেড ও মানের চা মিশ্রণ করে এই কাজই করে থাকেন তাঁরা। তাতে কোম্পানির একই নামের প্যাকেটজাত চায়ের স্বাদ সব সময় একই রকম হয়। আবার নিলামে চা তোলার আগে সম্ভাব্য মূল্য নির্ধারণ করার জন্য চায়ের নমুনা যাচাই করা হয় ব্রোকিং হাউসে (নিলাম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান)।
চায়ের এই গুণগত মান যাচাই করা হয় মূলত ভোক্তাদের জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে কেমন চা তুলে দেওয়া হবে, সেই বিবেচনা থেকে। চা বাজারজাতের আগে বিএসটিআই শুধু রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে চায়ের আর্দ্রতার মাত্রাসহ নানা উপাদান পরীক্ষা করে।
চায়ের মান যাচাই নিয়ে কথা হয় তিনটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চার দশকের অভিজ্ঞ একজন টি টেস্টারের সঙ্গে। মুঠোফোনে প্রথম আলোকে তিনি জানালেন, চা পরীক্ষকেরা চায়ের রং, উজ্জ্বলতা, ঘনত্ব ও সার্বিক অনুভূতি পরীক্ষা করেন। এ জন্য পঞ্চ ইন্দ্রিয় ব্যবহার করতে হয়। মূল কাজ হয় চা মুখে নেওয়ার পর।
চা পরীক্ষকেরা খাবারেও বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলেন। যেমন তাঁরা ধূমপান করেন না। পানও খান না। ভারী মসলাযুক্ত বা অতিরিক্ত ঝাল খাবারও এড়িয়ে চলেন। অর্থাৎ জিব ভারী হয়, এমন কোনো খাবার থেকে দূরে থাকেন তাঁরা। কারণ, জিবটাই তাঁদের পরীক্ষার মূল ‘যন্ত্র’।
তবে চা পরীক্ষকদের আসল ‘পরীক্ষা’ করেন ভোক্তারা। চায়ের শেষ চুমুকেই হয় এই পরীক্ষা। একজন টি টেস্টার জানালেন, চায়ের শেষ চুমুকের পর ভোক্তা যদি আরেকটু চা পান করতে চান, তাহলেই সার্থকতা ওই চায়ের পরীক্ষকের।