এলপিজি ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, প্রকাশ্যে এল অর্থ পাচার ও ভোক্তাস্বার্থ
এলপিজি আমদানিতে আধিপত্য নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে। ব্যবসায়ীদের এই দ্বন্দ্বে এলপিজি আমদানি নিয়ে অভিযোগ–পাল্টা অভিযোগ জমা পড়ছে সরকারি দপ্তরে। এমন দ্বন্দ্বে বেশি দাম দেখিয়ে এলপিজি আমদানির নামে বিদেশে ডলার পাচার এবং কম খরচে আমদানি হলেও ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে গ্যাস পাচ্ছে না—এমন দুটি বিষয় সামনে উঠে এসেছে।
ব্যবসায়ীদের এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ইস্টকোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরীর একটি অভিযোগের চিঠি নিয়ে। এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা লোয়াবের সভাপতির পদ ব্যবহার করে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ও ৬ অক্টোবর তিনি এই চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে। এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর সংগঠনের মহাসচিবের নামে নৌপরিবহন উপদেষ্টার কাছেও একই অভিযোগ করা হয়।
এসব চিঠিতে ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপিত রাষ্ট্র ইরান থেকে অবৈধভাবে এলপিজি আমদানি হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়। সর্বশেষ বন্দরের চেয়ারম্যানকে দেওয়া চিঠিতে ‘ক্যাপ্টেন নিকোলাস’ ও ‘গ্যাস জিএমএস’ ট্যাংকার থেকে এলপিজি খালাস বন্ধ করে তদন্তের আহ্বান জানানো হয়। তবে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই জাহাজ দুটি থেকে এলপিজি খালাস হচ্ছে।
আমদানিকারকেরা যেসব সরবরাহকারীর কাছ থেকে আমদানি করতে শুরু করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দিয়েছেন আজম জে চৌধুরী। এ রকম একটি সরবরাহকারী হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের মেরানো পেট্রোকেমিক্যালস। আজম জে চৌধুরীর বিপক্ষের ব্যবসায়ীরা বলছেন, মেরানো পেট্রোকেমিক্যালস থেকে ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডও পণ্য আমদানি করেছে। বিষয়টির সত্যতা জানতে এনবিআরের তথ্যের শরণাপন্ন হয় প্রথম আলো। এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ওমেরা পেট্রোলিয়াম মেরানো পেট্রোকেমিক্যালস ট্রেডিং থেকে এলপিজি আমদানি করেছে, যা ইরাক থেকে সরবরাহ হয়। এরপর আর আমদানি করেনি তারা।
লোয়াবের সভাপতি আজম জে চৌধুরী জ্বালানি খাতে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী। তিনি এলপিজি বাজারজাতকারী ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের পরিচালক। আবার জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আজম জে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউরোপ–আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আছে, এমন কোনো দেশ থেকে আমরা এলপিজি আমদানি করব না বলে সংগঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। সেই নৈতিক অবস্থান থেকে এই চিঠি দেওয়া হয়েছে। যেসব জাহাজে এলপিজি আমদানি হচ্ছে, সেসব জাহাজে কমপ্লায়েন্স (কর্মসহায়ক পরিবেশ) নেই। এলপিজির গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমস ও বন্দর কর্মকর্তারা জানান, অভিযোগের পর একটি প্রতিনিধিদল জাহাজ দুটি পরিদর্শন করেছে। তবে ইরান থেকে আমদানির সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিনিধিদল যাচাই–বাছাই করে ইরান থেকে এলপিজি আমদানির তথ্য পায়নি।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কোন দেশ থেকে এবং কী আমদানি করতে পারবেন বা পারবেন না, তা নির্ধারিত করা আছে আমদানি নীতি আদেশে। সর্বশেষ আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী, বাংলাদেশ শুধু ইসরায়েল থেকে পণ্য আমদানি করতে পারে না। তবে ইরান থেকে আমদানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ফলে ইরান থেকে আমদানি হলেও বাংলাদেশের আইনে তা অপরাধ নয়।
তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য খুব বেশি বাড়েনি। এনবিআরের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ইরান থেকে এক লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। ইরানে রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ১৭৬ কোটি টাকার পণ্য।
পাল্টা অভিযোগে যা আছে
আজম জে চৌধুরী যে দুটি জাহাজের এলপিজি খালাস বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন, সেই দুই জাহাজে এলপিজি আমদানি করেছে সাতটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান সাতটি হলো—যমুনা স্পেকটেক জয়েন্ট ভেঞ্চার, টিএমএসএস এলপিজি, বিএম এনার্জি, এনার্জিপ্যাক, ইউনিট্যাক্স এলপি গ্যাস, মেঘনা ফ্রেশ এলপিজি, জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস লিমিটেড।
আজম জে চৌধুরীর অভিযোগের বিরুদ্ধে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে গত সোমবার পাল্টা অভিযোগ দেন দুই জাহাজের আমদানিকারকসহ এলপিজি খাতের ১১ জন ব্যবসায়ী। তাঁরা বলেন, সংগঠনের সদস্যদের মতামত ছাড়া এই চিঠি ব্যবসায়িক প্রতিহিংসা। কারণ, আজম জে চৌধুরী ওমেরা এলপিজি লিমিটেড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের ‘এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের’ মাধ্যমে বাংলাদেশে একচেটিয়া এলপিজি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে চান। অতিরিক্ত মূল্যে এলপিজি আমদানি ও সরবরাহ দেখিয়ে সিঙ্গাপুরের কোম্পানিতে অর্থ স্থানান্তর করারও অভিযোগ করা হয় চিঠিতে।
অভিযোগের বিষয়ে এনবিআরের তথ্য পর্যালোচনা করে প্রথম আলো। তাতে দেখা যায়, চলতি মাসের প্রথম ১৩ দিনের আমদানি চালানের ঘোষিত মূল্যে ওমেরা পেট্রোলিয়ামস এলপিজির উপাদান বিউটেন ও প্রপেনের যেসব চালান আমদানি করেছে, সেগুলোর প্রতি টনের দাম ৭৩৫–৭৪০ ডলার। ওমেরাকে এসব চালান সরবরাহ করেছে এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড। কিন্তু দুই জাহাজে এলপিজি আমদানি করা ও অভিযোগকারী ১১ ব্যবসায়ী বিউটেন ও প্রপেনের যে চালান এনেছে, সেগুলোর প্রতি টনের দাম ৬৭৩ থেকে ৭২৬ ডলার। অর্থাৎ ওমেরার চেয়ে তুলনামূলক কম দরে এলপিজির উপাদান আমদানি করেছেন এসব ব্যবসায়ী।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আজম জে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলপিজির উপাদান যদি আমরা বেশি মূল্যে নিই, তাহলে তারা আগে কেন এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড থেকে আমদানি করত? আর এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড স্বচ্ছতা মেনে ব্যবসা করছে। তারা যদি কম দামে আমদানি করে তাহলে ভোক্তা কেন কম দরে এলপিজি পাচ্ছে না।’
দ্বন্দ্বের নেপথ্যে কি ব্যবসায়িক আধিপত্য
এলপিজির ব্যবসা বড় হচ্ছে। গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সোয়া ১৪ লাখ টন বিউটেন ও প্রপেন আমদানি হয়। ২০টি প্রতিষ্ঠান এই এলপিজি আমদানি করেছে। বর্তমানে এই বাজারের আকার প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার। লোয়াবের কর্মকর্তারা জানান, দেশে এলপিজি খাতে সক্রিয় আছে ২৬টি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত বিউটেন ও প্রপেন মিশিয়ে উৎপাদিত এলপিজি বোতলজাতের পর বাজারজাত করছে।
বাংলাদেশে এলপিজি আমদানিতে বড় অংশীদারি ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ২ লাখ ৯৮ হাজার টন এলপিজি আমদানি করে, যা দেশের মোট আমদানির ২১ শতাংশ। আবার সহযোগী প্রতিষ্ঠান এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডও দেশে এলপিজি সরবরাহে শীর্ষে রয়েছে। গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় পাঁচ লাখ টন এলপিজি সরবরাহ করেছে, যা বাংলাদেশে মোট সরবরাহের ৩৫ শতাংশ। ওমেরা ছাড়াও ছয়টি প্রতিষ্ঠান এমজেএল সিঙ্গাপুর থেকে এলপিজি আমদানি করেছে।
গত ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমানসহ অন্যান্য সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কম দামে এলপিজি আমদানি শুরু করে। চলতি অর্থবছরে এমজেএল সিঙ্গাপুর থেকে দেশীয় চারটি প্রতিষ্ঠান এলপিজি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এতে এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের অংশীদারি কমতে শুরু করে।
জানতে চাইলে ডেল্টা এলপিজি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত সরকারের আমলে এলপিজি খাতে আধিপত্য ছিল আজম জে চৌধুরীর। সরকারের পটপরিবর্তনের পর আমরা এখন সিঙ্গাপুরের এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড থেকে এলপিজি না এনে প্রতিযোগিতামূলক দরে অন্য দেশ থেকে আমদানি শুরু করেছি। এলপিজি সরবরাহে ব্যবসায়িক আধিপত্য হারানোর ভয়ে তিনি তাই নানা অভিযোগ করছেন।’
এ বিষয়ে আজম জে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগের নেপথ্যে ব্যবসায়িক কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সংগঠনের সভাপতি হিসেবে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করিনি। এমজেএল সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড এখনো টোটাল গ্যাসের মতো বড় প্রতিষ্ঠানকে এলপিজি সরবরাহ করছে।’