বেক্সিমকোর ১৬ কারখানা বন্ধ: শ্রমিকদের জানুয়ারি পর্যন্ত বেতন দেবে জনতা ব্যাংক
তৈরি পোশাকের রপ্তানি ক্রয়াদেশ না থাকা ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে না পারায় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬টি কারখানা লে-অফ বা বন্ধ ঘোষণা করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। কারখানাগুলো বন্ধ থাকলেও শ্রম আইন অনুযায়ী ডিসেম্বর ও জানুয়ারির বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ঋণ দেবে জনতা ব্যাংক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোয় কাজ করেন প্রায় ৩০ হাজার পোশাকশ্রমিক।
জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৪ নভেম্বর ‘বেক্সিমকো শিল্প পার্কের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনাবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটি’ গঠন করে। শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট এই উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। গত রোববার সচিবালয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এই কমিটির তৃতীয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে আরও দুই মাস জনতা ব্যাংক থেকে ঋণসহায়তা দেওয়া হবে। তারপর আর কোনো সহায়তা নয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোয় কাজ করেন প্রায় ৩০ হাজার পোশাকশ্রমিক।
উপদেষ্টা কমিটির এ সিদ্ধান্তের পর ওই দিনই, অর্থাৎ রোববার ১৬ কারখানায় লে-অফ ঘোষণা করে বেক্সিমকো। নোটিশে বলা হয়, কারখানায় কোনো কাজ না থাকায় ১৬ ডিসেম্বর থেকে শ্রম আইন অনুযায়ী লে-অফ থাকবে। লে-অফ চলাকালে শ্রমিকেরা আইন অনুযায়ী মজুরি পাবেন। এ সময় শ্রমিকদের সশরীর কারখানায় এসে হাজিরা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
জানতে চাইলে শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেক্সিমকোর পোশাক কারখানাগুলো আমরা সচল করার চেষ্টা করেছি। তবে গ্রুপটির কর্মকর্তারা আমাদের কোনো ধরনের সহায়তা করছিলেন না। চার মাস ধরে সরকার বেক্সিমকোর শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছে। এভাবে তো চলতে পারে না। তাই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আরও দুই মাস জনতা ব্যাংক ঋণ দেবে। তারপর কারখানা চলবে নাকি বন্ধ হবে, সেটি তাদের (বেক্সিমকো) সিদ্ধান্ত। তিনি জানান, বেক্সিমকো ফার্মা ও শাইনপুকুর সিরামিকস কারখানা চালু থাকবে।
সহযোগিতা না করার অভিযোগের বিষয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের পরিচালক (অর্থ ও করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) ওসমান কায়সার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দুই মাস আগে কারখানা লে-অফ করেছিলাম। তবে জোর করে সেটি প্রত্যাহার করানো হয়। তাতে আমাদের ১৫০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঋণপত্র খুলতে না পারায় আমরা ক্রয়াদেশ নিতে পারিনি। আমরা সরকারকে বলেছিলাম, ঋণপত্র খোলার ব্যবস্থা করে দিন। আমরা মাসে মাসে ব্যাংকের ঋণ শোধ করে দেব। এ সহায়তা না পেলে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া গতি নেই।’
গাজীপুরের সারাব এলাকায় বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ২৪টি কারখানায় কাজ করেন প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক। তবে ঋণ খেলাপি হওয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কাঁচামাল আমদানি করতে পারছে না বেক্সিমকোর কোম্পানিগুলো। এতে বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ অন্যত্র স্থানান্তর করে। প্রতি মাসে গড়ে তিন কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বেক্সিমকো।
বেক্সিমকোর পোশাক কারখানাগুলো আমরা সচল করার চেষ্টা করেছি। তবে গ্রুপটির কর্মকর্তারা আমাদের কোনো ধরনের সহায়তা করছিলেন না। চার মাস ধরে সরকার বেক্সিমকোর শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছে। এভাবে তো চলতে পারে না। তাই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আরও দুই মাস জনতা ব্যাংক ঋণ দেবে। তারপর কারখানা চলবে নাকি বন্ধ হবে, সেটি তাদের (বেক্সিমকো) সিদ্ধান্তশ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হন। অনেক ব্যাংকের সঙ্গে বেক্সিমকোর লেনদেন থাকলেও শুধু জনতা ব্যাংকে ঋণপত্র খোলা হতো। জনতায় গ্রুপটির ২৩ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে বড় অংশই এখন খেলাপি। গ্রুপটির ঋণ একক ঋণগ্রহীতার সীমাও অতিক্রম করায় বেক্সিমকোর নতুন করে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পথও বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে নিয়মিত বেতন–ভাতা দিতে না পারায় বেক্সিমকো গ্রুপের একাধিক কারখানায় শ্রম অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকদের মাসিক বেতন ৬০ কোটি টাকা আর কর্মকর্তাদের বেতন ১৫ কোটি টাকা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের দুটি ধারা শিথিল করে জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে বেক্সিমকোর কারখানার শ্রমিক–কর্মচারীদের বেতন–ভাতার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্প্রতি হাইকোর্টে এক রিটের শুনানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৬টি ব্যাংক ও ৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বেক্সিমকোর ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের দায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।
আমরা আবার চালু করার চেষ্টা করব। তবে শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না।বেক্সিমকো গ্রুপের পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী
শ্রমিকদের কী হবে
বেক্সিমকোর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ হলেও বস্ত্রকলগুলো চলছে। পাঁচটি বস্ত্রকলে কাজ করেন প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক। বস্ত্রকলগুলো সাবকন্ট্রাক্টে বা ঠিকা কাজ করে চালানোর পরিকল্পনার কথা জানান বেক্সিমকো গ্রুপের পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী। লে-অফ করা কারখানার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আবার চালু করার চেষ্টা করব। তবে শেষ পর্যন্ত কী হবে জানি না।’
প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকজন শ্রমিকনেতা জানান, শ্রম আইন অনুযায়ী, লে-অফ চলাকালে ৪৫ দিন পর্যন্ত মূল মজুরির অর্ধেক ও বাড়িভাড়া পাবেন শ্রমিকেরা। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে লে-অফ ১৫ দিন বাড়াতে পারবে মালিকপক্ষ। তখন মূল মজুরির চার ভাগের এক ভাগ আর বাড়িভাড়া পাবেন শ্রমিকেরা। তারপর যদি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়, তাহলে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা প্রতিবছর চাকরির জন্য একটি মূল মজুরি, বার্ষিক ছুটির টাকা এবং ভবিষ্য তহবিলের অর্থ পাবেন। তবে যাঁদের চাকরির বয়স এক বছরের কম, তাঁরা কোনো সুবিধা পাবেন না।
জানতে চাইলে গাজীপুর শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবু তালেব প্রথম আলোকে বলেন, বেক্সিমকোর কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শ্রমিকদের পাওনা কর্তৃপক্ষ দেবে। কোনো ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ নেই। শিল্প পুলিশের সদস্যরা কারখানা এলাকায় টহলে আছেন।