বার্ষিক ৭% মজুরি বাড়াতে রাজি মালিকেরা, শ্রমিকেরা চান ১২%

পোশাক কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরাফাইল ছবি: প্রথম আলো

দর-কষাকষিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট অতিরিক্ত আরও ১ শতাংশ বাড়াতে রাজি হয়েছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা। তার মানে নিম্নতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত পোশাকশ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি নিয়মিত ৫ শতাংশের সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ, অর্থাৎ ৭ শতাংশ বাড়াতে চান তাঁরা। যদিও শ্রমিকেরা এ প্রস্তাবে রাজি হননি। তাঁরা চান, বার্ষিক ১২ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি।

ন্যূনতম মজুরি পুনর্মূল্যায়ন ও বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় এ বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির চতুর্থ বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। সচিবালয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আজ মঙ্গলবার অতিরিক্ত সচিব সবুর হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মালিক ও শ্রমিকপক্ষের ছয়জন প্রতিনিধি।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠকে মালিক ও শ্রমিকপক্ষ নিজেদের দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। মালিকপক্ষ ৭ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিতে রাজি আছে জানালে শ্রমিকপক্ষ আগের অবস্থান থেকে সরে এসে ১২ শতাংশ দাবি করে। প্রথমে শ্রমিকপক্ষ অতিরিক্ত ১০ শতাংশসহ মোট ১৫ শতাংশ বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছিল। শ্রম মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির তৃতীয় বৈঠকে মালিকপক্ষ নিয়মিত ৫ শতাংশের সঙ্গে অতিরিক্ত ১ শতাংশসহ মোট ৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। তবে আজকের বৈঠকে শেষ পর্যন্ত বার্ষিক মজুরি কত শতাংশ বাড়বে, সেই বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় আগামী সপ্তাহে শ্রমসচিবের সভাপতিত্বে আবারও কমিটির বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহায়ক কমিটির সদস্য এ এন এম সাইফুদ্দিন ও বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের মহাসচিব ফারুক আহাম্মাদ, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুববিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার ও বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি কবির আহম্মেদ।

জানতে চাইলে ফজলে শামীম এহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর নিম্নতম মজুরি ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। ফলে নতুন করে আবার ১২ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি করা কারখানাগুলোর পক্ষে কঠিন। শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি যে দাবি করেছেন, সেই দাবি ২০-২৫ শতাংশ কারখানা পূরণ করতে পারলেও বাকিরা পারবে না। ধীরে ধীরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে আমরা ৭ শতাংশ বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছি।’

অন্যদিকে বাবুল আখতার বলেন, ‘মজুরি বাড়ানোর প্রসঙ্গ এলেই মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় দেখায়। অথচ বছর বছর পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। আবার প্রতিবছরই কিছু নতুন কারখানা হয়, আবার কিছু কারখানা বন্ধও হয়—পোশাক খাতে এটা নিয়মিত চিত্র। এ ছাড়া মালিকপক্ষ প্রায়ই বলে, মজুরি বাড়লেও ক্রেতারা পোশাকের দাম বাড়াবে না। অথচ ক্রয়াদেশ পেতে মালিকেরা চুপি চুপি কম দামে ক্রয়াদেশ নেন। ফলে আমরা বাস্তবতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ করেছি।’

গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ার শ্রমিকদের টানা বিক্ষোভ হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে গত সেপ্টেম্বরে ১৮টি বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিক ও শ্রমিকনেতারা সমঝোতায় পৌঁছান। সমঝোতা অনুযায়ী, ছয় মাসের মধ্যে মজুরি পুনর্মূল্যায়ন এবং নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারকে প্রতিবেদন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তারপর ন্যূনতম মজুরি পুনর্মূল্যায়ন ও বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধিসংক্রান্ত বিষয়ে সক্ষমতা ও করণীয় নির্ধারণ বিষয়ে একটি কমিটি করেছে শ্রম মন্ত্রণালয়। যদিও নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারকে প্রতিবেদন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি করা যায়নি।

গত ৪ নভেম্বর কমিটির দ্বিতীয় সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা নিম্নতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত বার্ষিক মজুরি ১৫ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবের পক্ষে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা যুক্তি দেন, পোশাকশ্রমিকদের মজুরি শোভন জীবনযাপনের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জীবনধারণের ন্যূনতম মান বজায় রাখার অনুপযুক্ত মজুরি হওয়ায় এ খাতে বৈষম্য বাড়ছে। সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনেও অপর্যাপ্ত মজুরি অন্যতম কারণ।