ষড়যন্ত্র করে রপ্তানিতে ভুল তথ্য দেখিয়ে নগদ প্রণোদনা কমানো হয়েছে: বিটিএমএ সভাপতি
রপ্তানির ক্ষেত্রে এত দিন ধরে ভুল তথ্য দেখিয়ে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে নগদ প্রণোদনা কমানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এটা একটা ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে আমাদের শিল্প খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।’
মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করে, তার সঙ্গে আমাদের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি তথ্যের মিল নেই। এ নিয়ে দুই বছর আগে রপ্তানিসংক্রান্ত জাতীয় কমিটিতে আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। তখন ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অন্যরা আমাদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা (গভর্নর) বলি আপনাদের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে, আপনারা (ব্যবসায়ী) বলেন কম”।’ এভাবে ষড়যন্ত্র করে ভুল তথ্য দেখিয়ে তাঁদের রপ্তানি প্রণোদনা কমানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মোহাম্মদ আলী।
আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিটিএমএ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন মোহাম্মদ আলী। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিটিএমএর সহসভাপতি ফজলুল হক ও ফায়জুর রহমান। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি রপ্তানির বিপরীতে নতুন করে নগদ সহায়তা কমানোর আদেশ জারি করে। এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানাতে বিটিএমএ সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করে।
সংবাদ সম্মেলনে বিটিএমএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বস্ত্র (টেক্সটাইল) ও তৈরি পোশাক শিল্প খাতে রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ধরনের বিকল্প না রেখে এভাবে নগদ সহায়তা কমানোয় দেশের বস্ত্র খাতের সক্ষমতা কমবে। নানাবিধ সংকটের কারণে ইতিমধ্যে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও অনেক কারখানা যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় অবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলার বা প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে নগদ প্রণোদনা আগের অবস্থায় নেওয়ার দাবি জানায় বিটিএমএ। একই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে বস্ত্রশিল্পের জন্য একটি যুগোপযোগী ‘টেক্সটাইল পলিসি’ নামে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং ব্যাংকঋণ পরিশোধের জন্য এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড প্রদানের দাবি জানায় সংগঠনটি৷
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, প্রতি অর্থবছরে বস্ত্র ও পোশাাক খাতে রপ্তানির বিপরীতে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকা নগদ প্রণোদনা দেয় সরকার। এটি দেশের প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটের তুলনাই খুবই সামান্য। এর বিপরীতে বিপুল পরিমাণ রপ্তানি আয়ে অবদান রাখছে বস্ত্র ও পোশাক খাত। কিন্তু সম্প্রতি বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা বাস্তবায়িত হলে তা এ দুটি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে জ্বালানিসংকটের কারণে স্বাভাবিক উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে গত কয়েক মাস যাবত তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে কারখানাগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতার ৪০-৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে সুতা ও কাপড় উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমেছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এতে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে এ খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে। এর প্রভাব তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে বস্ত্রশিল্পে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় বাজারও বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বর্তমানে জ্বালানিসংকট ছাড়াও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) পরিমাণ ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ডলার থেকে কমিয়ে ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি ডলার করা হয়েছে, ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশে উঠেছে, শ্রমিকের মজুরি ৭০ শতাংশ বেড়েছে, আর ডলার–সংকটের কারণে চলতি মূলধনের ঘাটতি চলছে এবং কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যা হচ্ছে।
এমন রকম পরিস্থিতিতে বস্ত্র খাতের সুরক্ষায় কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না করেই প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেটাকে সুচিন্তিত নয় বলে জানান মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা কমানোর ফলে বস্ত্রশিল্প মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। এমনকি ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি ভবিষ্যতে দেশের পাটশিল্পের মতো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
বিটিএমএ সভাপতি আরও জানান, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের কথা বলে নগদ সহায়তা কমানো হয়েছে বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। তবে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের এখনো প্রায় আড়াই বছর বাকি। আর এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলেও গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত শিল্প খাতগুলো নগদ প্রণোদনা পেতে পারে। ২০০৪ সালে প্রতিবেশী ভারতের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলেও দেশটি এখনো বস্ত্র খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নগদ সহায়তার বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা দিচ্ছে।
মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, যাঁরা প্রধানমন্ত্রী ও অন্য শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের বস্ত্রশিল্প সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে এবং নানামুখী চাপ প্রয়োগ করে এই শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা আসলে দেশকে বিদেশি বাজারে পরিণত করতে চান।