পোশাক খাতে তিন দশকে রপ্তানি বেড়েছে ২৪ গুণ, মজুরি বেড়েছে ১৩ গুণ
নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই পাট ও পাটজাত পণ্যকে হটিয়ে তৈরি পোশাক দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়। তখন পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৬২৭ টাকা। ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। সেই বোর্ড ন্যূনতম মজুরি ৯৩০ টাকা নির্ধারণ করে। তারপর ১২ বছর ন্যূনতম মজুরি আর পরিবর্তন হয়নি। যদিও রপ্তানি ধারাবাহিকভাবেই বেড়েছে।
১০ বছর আগে নিম্নতম মজুরি বোর্ডে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার টাকা থেকে মাত্র ৬০০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল মালিকপক্ষ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামেন শ্রমিকেরা। শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে মজুরি নির্ধারণ হয় ৫ হাজার ৩০০ টাকা। চলতি বছরও মালিকপক্ষ মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধির প্রস্তাবিত মজুরির অর্ধেক অর্থাৎ ১০ হাজার ৪০০ টাকা প্রস্তাব দিলে শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামেন। সেই আন্দোলনের মুখে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে। তাদের সেই প্রস্তাব ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। তারপরও শ্রমিকেরা শান্ত হচ্ছেন না।
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া পোশাকশ্রমিকদের দাবি, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরিতে তাঁদের প্রয়োজন মিটবে না। অন্যদিকে মালিকেরা পোশাকশিল্পের সক্ষমতাকে সামনে আনছেন। বলছেন, এই মজুরিই দিতে পারবে না অনেকে। যদিও গত ২৮ বছরে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২৪ গুণ। আর একই সময়ে পোশাকশ্রমিকের মজুরি বেড়েছে ১৩ গুণ।
আশির দশকের গোড়ার দিকে দেশে পোশাকশিল্পের উত্থান শুরু। আর নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই পাট ও পাটজাত পণ্যকে হটিয়ে তৈরি পোশাক দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত হিসেবে আবির্ভূত হয়। তখন পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৬২৭ টাকা। ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। সেই বোর্ড ন্যূনতম মজুরি ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৯৩০ টাকা নির্ধারণ করে। তারপর ১২ বছর ন্যূনতম মজুরিতে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি। যদিও তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবেই বেড়েছে।
২০০৬ সালে গঠিত নিম্নতম মজুরি বোর্ড পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১ হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে। তারপর ২০১০ সালে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা করা হয়।
২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড ও পরের বছর সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। তখন দেশে–বিদেশে পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ২০১৩ সালে পোশাকশ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করে। সেই বোর্ড মজুরি ৭৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে। শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর মজুরি পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়। সে অনুযায়ী, ২০১৮ সালে গঠিত মজুরি বোর্ড পোশাকশ্রমিকের মজুরি ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে।
তবে রপ্তানির পরিসংখ্যান বলছে, মজুরি যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে তৈরি পোশাক রপ্তানি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৪ সালে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ছিল ১৮৮ কোটি ডলারের। গত বছর সেই রপ্তানি বেড়ে ৪ হাজার ৫৭০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। তার মানে, গত ২৮ বছরে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২৪ গুণ। তার বিপরীতে পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি বেড়েছে ১৩ গুণ।
ধারাবাহিকভাবে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যানুযায়ী, বিশ্ববাজারে গত বছর তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি হিস্যা (মার্কেট শেয়ার) ছিল চীনের, ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ। তারপরেই বাংলাদেশের অবস্থান, বৈশ্বিক বাজারে হিস্যা ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ভিয়েতনামের হিস্যা ৬ দশমিক ১, তুরস্কের সাড়ে ৩ এবং ভারতের ৩ দশমিক ১ শতাংশ।
অবশ্য রপ্তানিতে এগিয়ে থাকলেও প্রতিযোগী দেশের তুলনায় মজুরিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ। ভারত, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের পোশাকশ্রমিকেরা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মজুরি পান। শুধু তা–ই নয়, দেশের কয়েকটি খাতের তুলনায় কম মজুরি দিচ্ছে শীর্ষ রপ্তানি আয়ের এই খাত।
২০১৩ সালে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৭৭ দশমিক ৭৫ টাকা। তাতে তখন পোশাকশ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৬৮ ডলার (৫ হাজার ৩০০ টাকা)। ২০১৮ সালে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে ৮৩ দশমিক ৯০ টাকা হয়। সে হিসাবে তখন নিম্নতম মজুরি ছিল ৯৫ ডলার (৮ হাজার টাকা)। এখন ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। সেই হিসাবে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দাঁড়াবে ১১৩ ডলার (১২ হাজার ৫০০ টাকা)।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে ভারতে পোশাকশ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ১৭১ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া চীনে ৩০৩, কম্বোডিয়ায় ২০০, ইন্দোনেশিয়ায় ২৪২, ভিয়েতনামে ১৭০ ও পাকিস্তানে ১১০ ডলার। বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি। চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোও (কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান) এ ক্ষেত্রে এগিয়ে।
মজুরি বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার টাকার বাইরে ওভারটাইম ও হাজিরা বোনাস যোগ করলে সেটি আরও কয়েক হাজার টাকা বাড়বে। এই শ্রমিকেরা দক্ষতা অর্জন করলে এক বছরের ব্যবধানে ওপরের গ্রেডে উন্নীত হন।
অবশ্য নতুন মজুরি বোর্ডের কাঠামো অনুযায়ী, পোশাকশিল্পে শিক্ষানবিশ শ্রমিকের মজুরি ৯ হাজার ৮৭৫ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ৯৫০ টাকা। এই শ্রমিকদের শিক্ষানবিশকাল ৬ মাস পর্যন্ত হয়। তারপরই তাঁরা ৫ নম্বর গ্রেডের ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরিতে যোগ দেবেন।
২০০৬ সালে নিম্নতম মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার। সেবার একপর্যায়ে মালিকপক্ষ ১ হাজার ৬০০ টাকা মজুরি দিতে রাজি হয়। তবে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত দর–কষাকষি করে আরও ৬২ টাকা ৫০ পয়সা আদায় করে নেন শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নাজমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মজুরি নিয়ে শ্রমিকদের লড়াই যুগ যুগ ধরে চলছে। যদিও মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনে কখনোই চলতি বছরের মতো চারজন পোশাকশ্রমিককে জীবন দিতে হয়নি। মজুরি বাড়ানোর এই পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে। শ্রমিকদের কথা শুনতে হবে, না হলে শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটবেই। তিনি আরও বলেন, বর্তমান শ্রমিক আন্দোলন দমাতে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, মামলা ও কারখানা বন্ধের মতো ব্যবস্থা নিচ্ছেন মালিকেরা। সেই পথে না গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা ও মজুরি পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দেন তিনি।