প্রাক্–বাজেট আলোচনা
যাচাই-বাছাই করে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার পরামর্শ ব্যবসায়ীদের
অর্থনৈতিকভাবে চলতি বছর খুবই চ্যালেঞ্জিং। তাই কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে অর্থনীতি সচল রাখতে হবে। নতুন প্রকল্প নিতে হবে যাচাই-বাছাই করে।
আগামী ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প নেওয়ার অনুরোধ করেছেন দেশের ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলেছেন, ইতিমধ্যে কয়েকটি বড় অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আরও কয়েকটির কাজ চলমান রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে চলতি বছর খুবই চ্যালেঞ্জিং। তাই কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে অর্থনীতি সচল রাখতে হবে। নতুন বছরের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হবে যৌক্তিকভাবে যাচাই-বাছাই করে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ আয়োজিত প্রাক্-বাজেট আলোচনায় ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। গতকাল সোমবার ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনসহ বিভিন্ন চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনায় তিনি আগামী তিন বছর নতুন বাজার ও ক্রেতা ধরার জন্য পণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে বলেছেন। কারণ, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার পর অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকবে না।ফারুক হাসান, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি
দেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার কম। রাজস্ব–জিডিপির নিম্নতম হার নিয়ে অর্থনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিভিন্ন খাত থেকে সমালোচনা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বলা হয়, বিভিন্ন খাতে সরকার যে কর ছাড় দেয়, তা না দিলে রাজস্ব–জিডিপির হার আরও বেশি থাকত। আইএমএফের পরামর্শে এনবিআর এখন কর ছাড় কমানোর বিষয়ে কাজ করছে। অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা এ ব্যাপারে সতর্ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
আলোচনায় এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন আগামী অর্থবছরের বাজেটে করহার কমিয়ে আয়কর ও মূসক বা ভ্যাটের আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। এ ছাড়া তিনি ফাঁকি দেওয়া কর আদায় জোরদার করতে কর কর্মকর্তাদের নিয়মিত বেতন-ভাতার বাইরে প্রণোদনা হিসেবে বিশেষ কমিশন দেওয়ার বিধান বাতিলের আহ্বান জানান।
পণ্য রপ্তানিতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। এ ছাড়া তৈরি পণ্যের আমদানি শুল্ক ২০৩০ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ এবং মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহার ৫ শতাংশ করার পরামর্শ দেন তিনি। নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত টার্নওভার হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) তালিকাভুক্ত করারও পরামর্শ দেন জসিম উদ্দিন।
প্রাক্–বাজেট আলোচনায় কী পরামর্শ দিয়েছেন—জানতে চাইলে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, তিনি করপোরেট কর নিয়ে কথা বলেছেন। চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ। তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, ৩৬ লাখ টাকার বেশি নগদ লেনদেন করা যাবে না। এ শর্তের কারণে ৯০ শতাংশের বেশি কোম্পানি করপোরেট কর কমানোর সুফল নিতে পারছে না। ফলে আগামী বাজেটে করপোরেট করকে শর্তমুক্ত করতে হবে।
সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বা ভ্যাট মেশিন বসানো বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান এমসিসিআই সভাপতি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে সাড়ে ৮ শতাংশ। সেটিকে ১০ শতাংশের ওপরে নিতে হলে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এনবিআরের শক্তিশালী কার্যক্রম থাকতে হবে। নিয়মনীতি সহজ করে সাধারণ মানুষকে কর প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সামির সাত্তার কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে করজাল বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে দেশের ৪৮ শতাংশ ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। যদিও সারা দেশ থেকে যে কর আদায় হয়, তার ৯০ শতাংশই এ দুই অঞ্চল থেকে আসে। তাঁর প্রশ্ন, তাহলে ঢাকা-চট্টগ্রামের বাইরের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবদান কোথায়? এ জায়গায় উন্নতি করতে হলে এনবিআরের লোকবল বৃদ্ধিসহ স্মার্ট কর্মকর্তা নিয়োগের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হলো, তা তিন থেকে ছয় মাস পর তদারক করে দেখতে হবে।
অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলেন সামির সাত্তার। তাঁর মতে, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য কাগজপত্রের ঘাটতির কারণে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। অথচ বড় ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংকে গেলেই ঋণ পাচ্ছেন। ফলে এ জায়গায় বিশেষ উদ্যোগ লাগবে।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান প্রথম আলোকে জানান, আলোচনায় তিনি আগামী তিন বছর নতুন বাজার ও ক্রেতা ধরার জন্য পণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে বলেছেন। কারণ, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার পর অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকবে না। তাই প্রয়োজনে তিন বছরের জন্য নগদ সহায়তা বাড়ানো যেতে পারে।
কৃত্রিম তন্তুর সুতা ও কাপড় এবং পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ায় সুতা ও কাপড় উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতে কর অব্যাহতির মতো সুবিধাও চেয়েছেন ফারুক হাসান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্ববাজারে যত পোশাক রপ্তানি হয়, তার চার ভাগের তিন ভাগই কৃত্রিম তন্তুর। এ খাতে নতুন বিনিয়োগ হলে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়বে। অন্যদিকে পণ্য পুনরুৎপাদনে নতুন নতুন কারখানা হলে আমাদের তুলা আমদানি কমবে। তাতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন বাড়বে।’
জানা গেছে, আলোচনায় সবার কথা শুনলেও তেমন কোনো মন্তব্য করেননি অর্থমন্ত্রী।