মৌসুমেও আলুর দাম না কমে বাড়ছে
সরবরাহে ঘাটতির কারণে দাম কমছে না। ভারত থেকে আলু আমদানি বন্ধ হওয়ার পর থেকে বাজার আরও চড়ে গেছে।
সাধারণত বাজারে নতুন আলু উঠলেই দাম কমতে শুরু করে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। বাজারে নতুন আলু উঠছে, পুরোনো আলুও আছে। কিন্তু দাম কমার বদলে বাড়ছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসেও পুরোনো আলু বেশ চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। অথচ অন্য বছরগুলোতে এ সময়ে পুরোনো আলুর চাহিদা একেবারে পড়ে যেত এবং দামও কমত। ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, এখনো নতুন আলু পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ হয়নি। সে কারণে নতুন ও পুরোনো দুই ধরনের আলুর দামই বাড়তি।
গতকাল সোমবার রাজধানীর মালিবাগ, মগবাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে নতুন ও পুরোনো আলুর কেজি পড়ছে ৮০ টাকা। পুরোনো আলুর দাম কোথাও কোথাও একটু কমে ৭০ টাকা কেজিতেও মিলছে। আবার নতুন আলু আকারে বেশি ছোট হলে সেটির দামও একটু কম রাখা হয়। তবে প্রমাণ সাইজের যেকোনো আলুই ৮০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। গত সপ্তাহ থেকে উভয় পদের আলুর দাম কেজিতে অন্তত ১০ টাকা বেড়েছে।
ঢাকার মালিবাগ বাজারের সবজি ব্যবসায়ী মো. শিপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলুর দাম কমার দিকে ছিল। কিন্তু এই মাসের শুরুতে একটা বৃষ্টি হয়। এরপরই বাজারে আলু কম আসতে শুরু করে। তাতে দামও বাড়তে থাকে। মৌসুমের শুরুতে নতুন আলুর দাম কয়েক দিন একটু বেশি থাকলেও পুরোনো আলুর দাম কখনো এত বেশি হতে দেখিনি।’
বাজারে নতুন আলু আসতে শুরু করায় স্থানীয় কৃষকদের সুরক্ষা দিতে নতুন করে আমদানির অনুমতি দেওয়ার চিন্তা নেই সরকারের। অন্যদিকে বাজারে পর্যাপ্ত আলু না আসায় দামও কমছে না।
বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভারত থেকে আলু আমদানি বন্ধ হওয়ার কারণেও বাজার চড়ে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এ সময়ে এবারই সর্বোচ্চ দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া নভেম্বরেও আলুর কেজি ৫০ টাকার আশপাশে ছিল। এবার অন্যান্য সবজির দামও বেশি। এটিও আলুর বাড়তি দামের আরেকটি কারণ।
শুধু রাজধানী ঢাকাতেই নয়, আলুর উৎপাদনস্থলেও বেশি দাম দেখা গেছে। যেমন গতকাল সোমবার জয়পুরহাট শহরের নতুনহাটে নতুন আলু খুচরায় ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সেখানকার আলু ব্যবসায়ী আশরাফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, আগাম জাতের আলুর সরবরাহ কম হওয়ায় দাম কমছে না। তবে কয়েক দিনের মধ্যে আলুর সরবরাহ বাড়বে। তখন দাম দ্রুত নেমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
* ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি নতুন-পুরোনো আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। * গত সপ্তাহ থেকে উভয় পদের আলু কেজিতে অন্তত ১০ টাকা বেড়েছে। * আগাম জাতের আলুর উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে সরবরাহ কম। * সরকার খুচরায় আলুর দাম প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা বেঁধে দিলেও কার্যকর হয়নি। * গত সেপ্টেম্বর থেকে দেশের আলুর বাজার চড়া। * এক দফায় ৬০ হাজার টন আলু আমদানি হলেও সংকট কাটেনি।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গত রোববারের বাজারদরের তালিকানুযায়ী, ঢাকায় মানভেদে প্রতি কেজি নতুন ও পুরোনো আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। সরকারি সংস্থাটির হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত এক মাসে আলুর দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশের মতো। গত বছরের এই সময়ে ঢাকার বাজারে নতুন ও পুরোনো আলুর কেজি ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। এর মানে, দেশে এক বছরের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১৮৯ শতাংশ।
আলুর দাম কমার দিকে ছিল। কিন্তু এই মাসের শুরুতে একটা বৃষ্টি হয়। এরপরই বাজারে আলু কম আসতে শুরু করে। তাতে দামও বাড়তে থাকে। মৌসুমের শুরুতে নতুন আলুর দাম কয়েক দিন একটু বেশি থাকলেও পুরোনো আলুর দাম কখনো এত বেশি হতে দেখিনি।সবজি ব্যবসায়ী মো. শিপন
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন বা হিমাগার সমিতির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, হিমাগারে পুরোনো আলু শেষ। এখন নতুন আলুর সময়। তবে এবার উঁচু জমিতে আগাম জাতের আলুর ফলন ব্যাহত হয়েছে। অন্যথায় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাজারে আলুর সরবরাহ ব্যাপকভাবে বাড়ত এবং দামও কমত।
বাজারে গত সেপ্টেম্বর থেকে হঠাৎ আলুর দাম বাড়তে শুরু করে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজিতে আলুর দাম ৩৫-৩৬ টাকা (হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭) বেঁধে দেয়। সেই সঙ্গে বাজারে অভিযান শুরু করে। জেলায় জেলায় হিমাগার পর্যায়েও তদারক করা হয়। তাতেও সুফল না পেয়ে গত ৩০ অক্টোবর আলু আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। আমদানির সিদ্ধান্তের পরও বাজারে বড় কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। প্রতি কেজির দাম ৫০ টাকার নিচে নামেনি।
আলু আমদানির অনুমতিপত্রের (আইপি) মেয়াদ ১৫ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সরকার এবার ৩ লাখ ৬ হাজার টন আলু আমদানির অনুমতিপত্র দিলেও দেশে আলু আসে ৬০ হাজার টন। অর্থাৎ আইপির ৫ ভাগের ১ ভাগের মতো আমদানি হয়েছে।
এদিকে বাজারে নতুন আলু আসতে শুরু করায় স্থানীয় কৃষকদের সুরক্ষা দিতে নতুন করে আমদানির অনুমতি দেওয়ার চিন্তা নেই সরকারের। অন্যদিকে বাজারে পর্যাপ্ত আলু না আসায় দামও কমছে না।
দেশে আলুর উৎপাদন ও চাহিদা নিয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত মৌসুমে আলু উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ৪ লাখ টন। আবার কৃষি মন্ত্রণালয়েরই আওতাভুক্ত সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী আলু উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১১ লাখ টন। এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, আলু উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ৯ লাখ টন। মন্ত্রণালয়সহ সরকারি তিন সংস্থার তথ্য বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যখন হিমাগার সমিতি জানায়, দেশে গত মৌসুমে সাকল্যে আলু উৎপাদিত হয়েছিল ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, দেশে বছরে আলুর মোট চাহিদা ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন। আবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে চাহিদা হচ্ছে ৮৯ লাখ টন। অন্যদিকে হিমাগার মালিক সমিতি মনে করে, দেশে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন।