ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কে দেশের ৯৫৭ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিতে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের কারণে বিশ্ববাণিজ্য এখন টালমাটাল। এতে বাংলাদেশের প্রায় এক হাজার রপ্তানিকারকের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ তৈরি হয়েছে। নতুন শুল্কের কারণে পণ্যের চাহিদা কমলে কিংবা ক্রয়াদেশ অন্যত্র স্থানান্তরিত হলে দেশের বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই তৈরি পোশাক কারখানা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৭ হাজার ৫৬১টি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ২১২টি দেশে পণ্য রপ্তানি করেছে। প্রচ্ছন্ন ও নমুনা পণ্য বাদে মোট রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ২৬৯ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ৭৬৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৩২৬টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান।

যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের এমন প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠান কতটা সংকটে আছে, সেটি এবার পর্যালোচনা করে দেখা যাক। সে দেশে পণ্য রপ্তানিকারক ২ হাজার ৩২৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯৫৭টিই করেছে মোট রপ্তানির এক–চতুর্থাংশের বেশি। গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাজারটিতে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৯৫ কোটি ডলার। ফলে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্কের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি ক্রয়াদেশ কমলে এসব প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এই ৯৫৭ প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি আবার সমান নয়—কারও বেশি, কারও কম। তবে উচ্চ ঝুঁকিতে আছে ২৮০টি প্রতিষ্ঠান। কারণ, তারা নিজেদের উৎপাদিত শতভাগ পণ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করে। যদিও তাদের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ কম, মাত্র ৩৫ কোটি ডলার। উচ্চ মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে ২৩৬টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। তাদের মোট রপ্তানির ৭৬-৯৯ শতাংশের গন্তব্যই যুক্তরাষ্ট্র। গত অর্থবছর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২২৭ কোটি ডলার।

যদি বাংলাদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চীন বা ভিয়েতনামের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়, তাহলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। আবার ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে হলে ঝুঁকি থাকবে।
—মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি

এ ছাড়া মধ্যম ঝুঁকিতে আছে ১৮১ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। তাদের মোট রপ্তানির ৫১-৭৫ শতাংশ হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। গত অর্থবছর তারা ১৭১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। নিম্ন মধ্যম ঝুঁকিতে থাকা ২৬০ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ১৫১ কোটি ডলার। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট রপ্তানির ২৬-৫০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।

তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে আছে ১ হাজার ৩৬৯ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। তাদের অবশ্য মোট রপ্তানি পণ্যের ১-২৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৮২ কোটি ডলার।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক প্রথম আলোকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে, তারা সাংঘাতিক ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে নীতি নিয়েছেন, সেটি কোনোভাবেই শূন্য করবেন বলে মনে হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ‘শুল্ক দুর্যোগের’ প্রভাব ইউরোপীয় ইউনিয়নেও (ইইউ) পড়তে পারে। কারণ, মার্কিন ক্রয়াদেশ কমলে প্রতিষ্ঠানগুলো ইইউতে পণ্য রপ্তানির চেষ্টা করবে। তাতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে। তখন আবার ইইউর ক্রেতারা দাম কমানোর সুযোগ নিতে পারে। সে জন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হয়।

পোশাকশিল্পেই বেশি দুশ্চিন্তা

২০২৩–২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৮৭ শতাংশই ছিল তৈরি পোশাক, যার মূল্য ৬৬৯ কোটি মার্কিন ডলার। ১ হাজার ৮১০টি প্রতিষ্ঠান গত অর্থবছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এ জন্যই ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে পোশাকশিল্পেই দুশ্চিন্তা বেশি।

প্যাসিফিক জিনস গ্রুপ গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারের ডেনিম পোশাক রপ্তানি করেছে। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপে আমাদের জন্য ইতিবাচক-নেতিবাচক দুটো দিকই আছে। আমাদের পোশাক রপ্তানিতে বৈচিত্র্যের কারণে রপ্তানি খুব বেশি কমার নেই। যেমন ডেনিমে আমরা আমাদের প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশ এগিয়ে, এটা অন্য প্রতিযোগীরা নিয়ে নেবে, সেই আশঙ্কা কম।’

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক বহাল থাকলে বড় প্রভাব পড়বে। এখন আমাদের ব্যবসায়ীদের করণীয় কিছু নেই। আমাদের সরকার যদি চেষ্টা করে কিছু একটা করে। তা না হলে যা হবে, সেটি আমাদের মেনে নিতে হবে।
—এ কে আজাদ, এমডি, হা-মীম গ্রুপ

তৈরি পোশাকের পর যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাত হচ্ছে ক্যাপ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে সে দেশে ৩৩ কোটি ডলারের ক্যাপ রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ২২ কোটি ৫২ লাখ ডলারের পণ্য। তার মানে মোট ক্যাপ রপ্তানির ৬৮ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।

এই বাজারে পণ্য রপ্তানিতে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চামড়ার জুতা। গত অর্থবছরে দেশ থেকে সব মিলিয়ে চামড়ার জুতা রপ্তানি হয় প্রায় ৫৫ কোটি ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চামড়ার জুতা রপ্তানি হয়েছে ১৮ কোটি ডলারের জুতা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে হোমটেক্সটাইল, পরচুলা, জুতা ছাড়া চামড়াজাত পণ্যসামগ্রী।

রপ্তানির জন্য কনটেইনারবাহী পণ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে।
ফাইল ছবি: সৌরভ দাশ

যেসব প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিতে আছে

দেশি গ্রুপগুলোর মধ্যে শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হা-মীম গ্রুপ। তারা গত অর্থবছরে ৬৩টি দেশে ৫৮ কোটি ৯১ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এর প্রায় ৭৪ শতাংশ পণ্যই রপ্তানি হয়েছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে। একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে হা–মীম গ্রুপের রিফাত গার্মেন্টস যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির পরিমাণ ২১ কোটি ডলার। এ ছাড়া তাদের অ্যাপারেল গ্যালারির প্রায় শতভাগ পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে।

জানতে চাইলে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক বহাল থাকলে বড় প্রভাব পড়বে। এখন আমাদের ব্যবসায়ীদের করণীয় কিছু নেই। আমাদের সরকার যদি চেষ্টা করে কিছু একটা করে। তা না হলে যা হবে, সেটি আমাদের মেনে নিতে হবে।’

চট্টগ্রামের এশিয়ান-ডাফ গ্রুপ গত অর্থবছরে ২৮ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই রপ্তানি হয়েছে ৯০ শতাংশ পণ্য। গ্রুপটির সুবর্ণ গার্মেন্টস ও সি ব্লু টেক্সটাইলের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রায় শতভাগ পণ্য যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।

এ বিষয়ে এশিয়ান–ডাফ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ সালাম বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপে আমরা উদ্বিগ্ন। দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে এই বাড়তি শুল্ক কমিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও চীনের ওপর পাল্টা শুল্ক বেশি হওয়ায় তা আমাদের জন্য ইতিবাচক হবে। আবার ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশের ওপর আমাদের চেয়ে শুল্ক কম হওয়াটাও চ্যালেঞ্জের। যদিও দেশ দুটির উৎপাদন সক্ষমতা আমাদের চেয়ে অনেক কম।’

সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ দরকার

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি বেশি। এ ঝুঁকি নির্ভর করবে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগী কারা, তাদের ওপর। যদি বাংলাদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চীন বা ভিয়েতনামের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়, তাহলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। আবার ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে হলে ঝুঁকি থাকবে। অবশ্য পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক বাজারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ আশঙ্কা সত্য হলে সব বাজারের জন্যই তা ঝুঁকি তৈরি করবে।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টার মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা ইতিবাচক। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা বা টিকফার মতো প্ল্যাটফর্মও ব্যবহার করে যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা করা দরকার। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারি পণ্য ক্রয় বৃদ্ধি, বেসরকারি আমদানি উৎসাহিত করা এবং শুল্ক যৌক্তিকীকরণের সম্ভাবনা বিচার করে নিজেদের প্রস্তুতিও নিয়ে রাখা দরকার।