এবার আটা-ময়দা উৎপাদনে প্রাণ, সক্ষমতা প্রতিদিন ৫০০ টন
দেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারে এবার আটা, ময়দা ও সুজি নিয়ে এসেছে শীর্ষস্থানীয় প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের প্রতিষ্ঠান প্রাণ। গাজীপুরের কালীগঞ্জে অবস্থিত প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের নতুন শিল্পপার্কে ইতিমধ্যে এসব পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি শুরু হয়েছে।
আটা-ময়দা ছাড়াও প্রাণের এ শিল্পপার্কে ভোজ্যতেল, লবণ, ডাল, স্টার্চ, মসলা, বেভারেজ, নুডলস, বিস্কুট, কনফেকশনারি, পোলট্রি ফিড ও ফ্লেক্সিবল প্যাকেজিংসহ বেশ কয়েকটি পণ্য উৎপাদিত হবে।
কালীগঞ্জের মুক্তারপুর ইউনিয়নে ১৮০ বিঘা জমিতে ‘কালীগঞ্জ এগ্রো প্রসেসিং লিমিটেড’ নামের এ শিল্পপার্ক স্থাপনে প্রাথমিকভাবে দেড় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে প্রাণ-আরএফএল। ইতিমধ্যে সেখানে প্রায় ৭১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। শিল্পপার্কটি পুরোপুরি চালু হলে সেখানে তিন হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে প্রায় ৯০০ লোক কাজ করছেন।
সরেজমিনে এই শিল্পপার্কের অগ্রগতি দেখতে গতকাল শনিবার ঢাকা থেকে একদল সাংবাদিক সেখানে যান। তাঁদের প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা ও প্রাণের নির্বাহী পরিচালক নাসের আহমেদ কয়েকটি কারখানা ঘুরিয়ে দেখান।
উৎপাদন সক্ষমতা ৫০০ টন
শিল্পপার্কটিতে প্রায় ২১ বিঘা জায়গায় ১০ তলার সমান উচ্চতায় নির্মাণ করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় ফ্লাওয়ার মিল বা আটা-ময়দার কারখানা। কারখানার সব যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি আনা হয়েছে ইউরোপ থেকে। পণ্যের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক পরীক্ষাগার। কারখানা নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপনে এ পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১১০ কোটি টাকা।
প্রাণ গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, কাঁচামাল রাখার জন্য এই শিল্পপার্কে বর্তমানে ১০ হাজার টন সক্ষমতার ছয়টি ও এক হাজার টন সক্ষমতার তিনটি সাইলো (শস্যাগার) রয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও ছয়টি সাইলো তৈরি করা হবে। আমদানি করা গম লাইটার জাহাজ থেকে সরাসরি সাইলোতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম চলে যায় প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রে। এরপর কয়েকটি ধাপে গম থেকে ময়লা আলাদা করে পরিষ্কার গম চূর্ণ করা হয়। এরপর উৎপাদিত আটা, ময়দা ও সুজি সরাসরি মোড়কজাত করে পাঠানো হয় বাজারে তথা ভোক্তার কাছে।
কর্মকর্তারা জানান, কারখানাটিতে দৈনিক ৫০০ টন আটা, ময়দা ও সুজি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে শিগগিরই উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। উৎপাদিত এসব পণ্য ‘প্রাণ’ ব্র্যান্ডের নামেই বাজারজাত করা হচ্ছে। এখন ৫০ কেজির বস্তায় করে নিজস্ব সরবরাহকারীর মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে আটা-ময়দা পৌঁছানো হয়। পরীক্ষামূলকভাবে ১ কেজি ও ২ কেজির প্যাকেট বাজারে ছাড়া হচ্ছে।
প্রাণের নির্বাহী পরিচালক নাসের আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, তাঁরা রাশিয়া, ইউক্রেন, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি করে আটা-ময়দা উৎপাদন করছেন। কারণ, এসব অঞ্চলের গমে প্রোটিনের মাত্রা ভালো থাকে। তবে স্থানীয়ভাবেও দেশের কয়েকটি জেলা থেকে ভালো মানের গম সংগ্রহ করা হবে। এ ছাড়া প্রাণ জমি ইজারা নিয়ে ভালো প্রোটিন পাওয়া যায় এমন জাতের গম উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। এ জন্য দেশের উত্তরাঞ্চলে ৬০০ একর জমি ইজারা নেওয়া হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, দেশে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বিভিন্ন কারখানায় বছরে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে, যার বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। উৎপাদিত আটা-ময়দার প্রায় ৭৫ শতাংশ ব্যবহার হয় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও হোটেলে, বাকিটা ভোক্তারা বাসাবাড়িতে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহার করেন। সব মিলিয়ে দেশে আটা, ময়দা ও সুজির বাজার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার। প্রতিবছর এ বাজার ৮-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
আরও যেসব কারখানা রয়েছে
সরেজমিনে দেখা যায়, কালীগঞ্জে প্রাণের শিল্পপার্কে আটা-ময়দা ছাড়াও ডাল, প্রাণিখাদ্য ও প্যাকেজিংসহ কয়েকটি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি কারখানার যন্ত্রপাতি বসানো হচ্ছে। বাকি কারখানাগুলো নির্মাণাধীন। আগামী দুই বছরের মধ্যে সব কারখানা উৎপাদনে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ কিছু কারণে আড়াই বছর ধরে দেশীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো চাপে রয়েছে। তাদের দাবি, যে পরিমাণে ব্যয় বেড়েছে, সে তুলনায় তারা পণ্যের দাম বাড়াতে পারছে না। এ রকম অবস্থায় এ খাতে নতুন বিনিয়োগে এসেছে প্রাণ।
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, ‘আমরা বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য তৈরি করছি, যার মূল কাঁচামাল আটা-ময়দা। এ কারণে প্রথম দিকে পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) হিসেবে কালীগঞ্জে আটা-ময়দার কারখানা করতে চেয়েছি। তবে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে আটা-ময়দার চাহিদাও ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে। আবার বিস্কুট, বেকারি, নুডলস ও ফ্রোজেন ফুডসের বাজারও দিন দিন বড় হচ্ছে। এসব কারণে কারখানা বড় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ইলিয়াছ মৃধা আরও বলেন, ‘আমরা দেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভালো অবস্থান তৈরি করতে চাই। এর মাধ্যমে ভোক্তারা ভালো মানের পণ্য পাবেন বলে আশা করছি।’