জর্দার ব্যবসা ধরে রাখবেন কাউছ মিয়ার ছেলেরা
চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে পড়েন দেশের অন্যতম শীর্ষ করদাতা ও জর্দা ব্যবসায়ী মো. কাউছ মিয়া। প্রথমে বাসায় তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও পরে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মাঝে দেড় মাস সিঙ্গাপুরেও চিকিৎসা নেন। তিনি অসুস্থ থাকায় পুরান ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ি রোডের হাকীমপুরী জর্দার কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
মো. কাউছ মিয়া রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার রাতে মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। তিনি স্ত্রী হাজেরা বেগম এবং আট ছেলে ও আট মেয়ে রেখে গেছেন। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার আরমানীটোলা মাঠে জানাজা শেষে আলোচিত এই জর্দা ব্যবসায়ীকে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
কাউছ মিয়ার সন্তান মানিক মিয়া গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবার অনেক বয়স হলেও চার-পাঁচ ঘণ্টা অফিস করতেন। সবশেষ গত ৫ জানুয়ারি অফিস করেছেন। তাঁর চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমরা ভাইয়েরা হাকীমপুরী জর্দার কারখানায় সময় দিতে পারিনি। ফলে কয়েক মাস ধরে কারখানাটি বন্ধ।’ তিনি বলেন, ‘বাবার ব্যবসায় আমরা পাঁচ ভাই যুক্ত রয়েছি। আমরা আবার এই কারখানা চালু করব।’
টানা ১৫ বছর ধরে দেশসেরা করদাতাদের একজন ছিলেন কাউছ মিয়া। সবশেষ ২০২২-২৩ করবর্ষে ব্যবসায়ী শ্রেণিতে তিনি সেরা করদাতা সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২০-২১ করবর্ষে মুজিব বর্ষের সেরা করদাতা হন তিনি। ওই বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাঁকে এই সম্মাননা দেয়।
১৯৫৮ সাল থেকে কাউছ মিয়া নিয়মিত আয়কর দেন। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁকে সেরা করদাতার স্বীকৃতি হিসেবে সনদ ও ক্রেস্ট দিয়েছিল। এ নিয়ে একবার কাউছ মিয়া প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘তখন আমি খুব অবাক হলাম। এত বড় বড় ব্যবসায়ী রেখে আমারে কেন ক্রেস্ট দিল, সেটা আমার মাথাতে ধরে না। গেলাম কর অফিসে। এখন যেখানে জাতীয় সংসদ ভবন, সেখানে ছিল এই অফিস। এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলাম, আমাকে কেন দেওয়া হলো? তিনি বলেন, ‘ছয় বছর ধরে গোপনে খোঁজখবর নেওয়ার পরই আপনাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।’
১৯৩১ সালে চাঁদপুরে কাউছ মিয়ার জন্ম। ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে ওঠেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের কারণে আর পড়াশোনা হয়নি। ১৯৫০ সালে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি চাঁদপুরে ব্যবসা শুরু করেন। ১৮ ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট ছিলেন। একপর্যায়ে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব হয়। ১৯৭০ সালে আট লাখ টাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন কাউছ মিয়া। তামাক বেচাকেনা শুরু করেন। এর পাশাপাশি শান্তিপুরী জর্দা বানিয়ে তা বাজারজাত শুরু করেন তিনি।
কাউছ মিয়া ১৯৭৬ সালে তাঁর হাকীমপুরী, শান্তিপুরী ও মানিক জর্দার ট্রেডমার্ক নেন। সেই কারখানা বন্ধ হলে ’৮০ সালের দিকে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। আগা নওয়াব দেউড়ি রোডে ভাড়া করা কারখানায় তিন-চারজন শ্রমিক নিয়ে শুরু করেন জর্দা তৈরি। প্রথম দিকে মাসে ১০ থেকে ১৫ মণ জর্দা বিক্রি হলেও পরে সেটি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এরই মধ্যে কার্গো জাহাজের ব্যবসায় নামেন কাউছ মিয়া।
বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হলেও সব সময় সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন কাউছ মিয়া। বেশ কয়েক বছর আগে দুবার তাঁর কারখানায় গিয়ে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক দেখেন, ছোট একটি কক্ষে অফিস করেন তিনি। সেখানে আসবাব বলতে একটি ছোট খাট, দু-তিনটি চেয়ার, একটি টেবিল আর একটি স্টিলের আলমারি। খাটটির এক পাশে বসেন কাউছ মিয়া। পাশেই একটা কোলবালিশ।
ওই সময় নিয়মিত কর দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাউছ মিয়া বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি ফাঁকি দেওয়া শিখি নাই।’ মা বলেছিলেন, ‘সৎ পথে চলবা। সৎভাবে ব্যবসা করবা। তোমার উন্নতি কেউ ঠেকাতে পারবে না। সত্যিই, আমি যে ব্যবসাতেই হাত দিয়েছি, সেখানে লাভ করেছি। ঠকা খাইনি।’
ব্যবসার পাশাপাশি বাড়ি কেনার অদ্ভুত খেয়াল ছিল কাউছ মিয়ার। ঢাকার মহাখালী, গ্রিন রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁর নিজের বাড়ি রয়েছে। যদিও তিনি বসবাস করতেন পুরান ঢাকার আরমানিটোলায়—এমনটাই জানান তাঁর সহকারী আলী আহমেদ। গতকাল তিনি কাউছ মিয়ার জানাজা শেষে প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যারের সঙ্গে ১৫ থেকে ১৬ বছর ছিলাম। খুবই ভালো লোক ছিলেন তিনি। ’
কাউছ মিয়ার ছেলে মানিক মিয়া বলেন, ‘বাবা খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। তাঁর বড় গুণ ছিল সততা। কারও সঙ্গে কথার বরখেলাপ করতেন না। সব সময় সত্য কথা বলতেন। তিনি আমাদের আদর্শ।’