সংকটে কুঁড়ার তেলের ১৭ কারখানা

দেশে তৈরি কুঁড়ার তেলের বড় অংশই রপ্তানি হয়। কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন কমে যাওয়ায় রপ্তানিও কমতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত চালের কুঁড়ার তেলের বড় একটি অংশ উৎপাদিত হয় বগুড়ায়। বগুড়া শহরের ফতেহ আলী বাজারে বিক্রির জন্য দোকানে রাখা হয়েছে এই তেল। গতকালের ছবি
প্রথম আলো

চালের কুঁড়ার সংকটে দেশের ১৭টি রাইস ব্র্যান অয়েল বা চালের কুঁড়ার তেলের কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এরই মধ্যে কাঁচামাল–সংকটে বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আর কোনো কোনোটি চলছে অনিয়মিতভাবে। এতে অপরিশোধিত চালের কুঁড়ার তেলের রপ্তানি কমে গেছে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রতিবছর গড়ে ২ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত চালের কুঁড়ার তেল রপ্তানি হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। গতকাল ভারতের বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত চালের কুঁড়ার তেলের রপ্তানিমূল্য ছিল ১ হাজার ৩২০ ডলার। সেই হিসাবে চালের কুঁড়ার তেল রপ্তানি থেকে বছরে আয় ২৮ কোটি ৮ লাখ মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৯৭৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এ বছর কাঁচামালের সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এ খাত থেকে রপ্তানি আয়ও কমতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

বাংলাদেশ রাইস ব্র্যান অয়েল মিলস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, দেশের রাইস ব্র্যানের ১৭টি কারখানার মধ্যে শুধু বগুড়াতেই আছে ৬টি কারখানা। এর মধ্যে একটি কারখানায় উৎপাদিত চালের কুঁড়ার তেল পরিশোধন করে দেশে বাজারজাত করা হয়। বাকি পাঁচটি কারখানায় উৎপাদিত অপরিশোধিত চালের কুঁড়ার তেল ভারতে রপ্তানি হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ পাঁচটি কারখানা থেকে ভারতে প্রায় পৌনে ৮ কোটি ডলার বা ৮২১ কোটি টাকার চালের কুঁড়ার তেল রপ্তানি হয়েছে। 

শুধু আগস্ট মাসে চালের কুঁড়ার তেল রপ্তানি করে আয় হয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে তা কমে নেমে এসেছে ৪১ লাখ ৩৫ হাজার ডলারে। এক মাসের ব্যবধানে রপ্তানি আয় কমেছে দেড় লাখ ডলারের বেশি। 

এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, চালের কুঁড়ার তেল উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল চালের কুঁড়া বা চালের ওপরের পলিশ। এই কুঁড়ার সরবরাহ হয় বিভিন্ন চালকল থেকে। কিন্তু চালের অভাবে অধিকাংশ চালকল এখন বন্ধ। এতে চালের কুঁড়ার সংকট তৈরি হয়েছে। কারখানামালিকেরা বলছেন, বাজারে নতুন আমন ধান উঠতে আরও মাসখানেক সময় লাগবে। চালের কুঁড়ার জন্য সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

জানা যায়, বগুড়ার ছয়টি রাইস ব্র্যান অয়েল মিলের মধ্যে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডে উৎপাদিত চালের কুঁড়ার তেল পরিশোধন করে দেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। বাকি কারখানাগুলোর মধ্যে শেরপুর উপজেলার মজুমদার প্রোডাক্টস, ওয়েস্টার্ন অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস ও আলাল অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টস, শাজাহানপুর উপজেলার তামিম অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ এবং কাহালু উপজেলার আল-নুর অ্যাগ্রোর কারখানায় উৎপাদিত তেল ভারতে রপ্তানি হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১২ সালে দেশীয় ভোজ্যতেলের বাজার ধরতে বগুড়ার শেরপুরে মজুমদার প্রোডাক্টস উৎপাদনে যায়। কিন্তু নানা সংকটে দেশীয় বাজারে টিকতে না পেরে ২০১৬ সাল থেকে উৎপাদিত চালের কুঁড়ার তেল ভারতে রপ্তানি শুরু করে। প্রতি মাসে রেকর্ড পরিমাণ কুঁড়ার তেল ভারতে রপ্তানি করছে প্রতিষ্ঠানটি।

‘স্বর্ণা’ ব্র্যান্ডের চালের কুঁড়ার তেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মজুমদার প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্ত মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় দৈনিক ৯০ মেট্রিক টন ও ৭০ মেট্রিক টন তেল উৎপাদনের জন্য দুটি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে চালের কুঁড়ার সংকটে তিন মাস ধরে ৭০ মেট্রিক টন উৎপাদন সক্ষমতার ইউনিটটি বন্ধ আছে। দৈনিক ৯০ মেট্রিক টন উৎপাদন সক্ষমতার ইউনিটটি চালু থাকলেও কাঁচামাল–সংকটে কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কারখানার একটি ইউনিট চালু রাখতে গড়ে প্রতিদিন ২৬ ট্রাক চালের কুঁড়ার দরকার হয়। এখন সেখানে কুঁড়া মিলছে চাহিদার অর্ধেক।

‘ধানী’ ব্র্যান্ডের চালের কুঁড়ার তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তামিম অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান শাহজাহান আলী বলেন, ‘চালকল বন্ধ থাকায় বেশ কিছু দিন ধরেই চালের কুঁড়ার সংকটে রয়েছি আমরা। এক দিন কারখানা চালু, এক দিন বন্ধ—এভাবে উৎপাদন কার্যক্রম চলছে। এতে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাজারে নতুন ধান না আসা পর্যন্ত এ সংকট কাটবে না।’

 উদ্যোক্তারা জানান, দেশে চালের কুঁড়ার তেলের মোট উৎপাদনক্ষমতা ২ লাখ ৬০ হাজার টন। অথচ বছরে ধান থেকে যে পরিমাণ কুঁড়া পাওয়া যায়, তা দিয়ে ৫ লাখ টন কুঁড়ার তেল উৎপাদন সম্ভব। তা সত্ত্বেও চাহিদা অনুযায়ী কুঁড়া মিলছে না। মজুমদার প্রোডাক্টসের চিত্ত মজুমদার বলেন, এখনো বেশির ভাগ ধান ভাঙানো হয় সাধারণ মিলে। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয় চালের মিলের কুঁড়া থেকেই শুধু তেল উৎপাদন করা যায়। এ কারণে কুঁড়ার সংকট কাটছে না।

বেড়েছে উৎপাদন খরচ

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চালের কুঁড়ার দামেও। ২০১০ সালে দেশে যখন চালের কুঁড়া থেকে তেল উৎপাদন শুরু হয়, তখন প্রতি কেজি কুঁড়ার দাম ছিল গড়ে ১২ টাকা। কয়েক মাস আগেও মিল পর্যায়ে প্রতি কেজি কুঁড়ার দাম ছিল ২৬ থেকে ২৮ টাকা। এখন তা কিনতে হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি। এতে কুঁড়ার তেলের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে এ তেলের দামও। আগে মিলগেটে প্রতি লিটার কুঁড়ার তেলের দাম ছিল ৯০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা।

 এক যুগেও ‘জনপ্রিয়’ হয়নি কুঁড়ার তেল 

বাংলাদেশ রাইস ব্র্যান অয়েল মিলস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, দেশে চালের কুঁড়া থেকে তেল উৎপাদন শুরু হয় ২০১০ সালে। এখন দেশে চালের কুঁড়ার তেল উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে ১৭টিতে। অথচ এক যুগেও দেশের বাজারে ‘জনপ্রিয়’ হয়নি এ তেল। কারণ হিসেবে উদ্যোক্তারা বলছেন, বাজার ধরতে একের পর এক কারখানা স্থাপন করা হলেও নানা কারণে দেশের বাজারে এ তেল প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। শুরুর দিকে প্রতি লিটার কুঁড়ার তেলের বাজারমূল্য ছিল ১৯০ টাকা। এ দামে তেল বিক্রি করে ভালো লাভও করেছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু কারখানা বেড়ে যাওয়ায় বাজার ধরতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তাতে দামও পড়ে যায়। এতে হাতে গোনা দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখেও পড়ে। বাধ্য হয়ে অধিকাংশ উদ্যোক্তা দেশের বাজারের বদলে রপ্তানিতে ঝুঁকে পড়েন। 

 উদ্যোক্তারা বলছেন, শুরুতে অপরিশোধিত চালের কুঁড়ার তেল রপ্তানির বাজার ছিল ভারত, চীন,অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড,কোরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ। এখন  শুধু ভারতেই এ তেল রপ্তানি হচ্ছে।

বাংলাদেশ রাইস ব্র্যান অয়েল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও অ্যাগ্রোটেক ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকাশ দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচামাল–সংকটে বেশির ভাগ কারখানা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। অনিয়মিতভাবে কয়েকটিতে উৎপাদন চলছে।

যেভাবে তৈরি হয় কুঁড়ার তেল

ধানের তুষ তুলে ফেলার পর চালের ওপরের লালচে আবরণই মূলত রাইস ব্র্যান। বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই রাইস ব্র্যান থেকে বের করা হয় অপরিশোধিত তেল। এরপর পরিশোধনের মাধ্যমে তৈরি হয় কুঁড়ার তেল। বিদেশে রপ্তানি করা কুঁড়ার তেল পরিশোধনের পর ভোজ্যতেল হিসেবে বাজারজাত করা হয়। রাইস ব্র্যান থেকে অপরিশোধিত তেল নিষ্কাশনের পর পাওয়া যায় ডি-অয়েলড রাইস ব্র্যান (ফিড মিলের কাঁচামাল), যা পশু-পাখির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।