রমজানের আগেই বাড়তে শুরু করেছে মাংসের দাম
বাজারে এখন গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়।
দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে গরুর মাংসের দাম কেজিতে অন্তত ৫০ টাকা বেড়েছে।
নির্বাচনের পরেই ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে অন্তত ১০ টাকা বেড়েছে।
নির্বাচনের পরে বাজারে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। চাল, আটা, তেল, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম চড়া। সামনে আসছে পবিত্র শবে বরাত ও রমজান মাস। এবার রমজানের দেড় মাস আগেই মাংসের দাম বাড়তি। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। এবারও তেমন ইঙ্গিত আগেভাগেই পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ছোলা ও ডালের মতো পণ্যের দাম বেড়েছে। বাড়তি ডিমের দামও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ কমেছে।
গতকাল রোববার রাজধানীর মালিবাগ, মগবাজার ও শাহজাহানপুর বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে এখন গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা গরুর মাংস বিক্রি করেছেন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে গরুর মাংসের দাম কেজিতে অন্তত ৫০ টাকা বেড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, কসাইখানাগুলোতে গরুর সরবরাহ কমার কারণে মাংসের দাম বেড়েছে।
নির্বাচনের আগে গরুর মাংসের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তবে সম্প্রতি গরুর মাংসের দামের বিষয়ে ব্যবসায়ীরা সভা করেছেন বলে জানিয়েছেন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মুর্তজা। সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন থেকে গরুর মাংসের কোনো নির্ধারিত দাম থাকবে না। কারণ, নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে গিয়ে অনেক ব্যবসায়ী লোকসান করছেন। চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে মাংসের দাম নির্ধারিত হবে। তবে ক্রেতাদের সক্ষমতার কথা চিন্তা করে মাংসের দাম যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখা হবে।’
অন্যদিকে বাজারে খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি। মাসখানেক আগে বাজারে যখন গরুর মাংসের দাম কম ছিল, তখন খাসির মাংস ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মূলত গরুর মাংসের দাম কমার ফলে বাজারে খাসিসহ অন্যান্য মাংসের দামে এর প্রভাব ছিল। দাম কম ছিল ব্রয়লার মুরগিরও। তবে বাজারে এখন প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। কোথাও কোথাও ২২০ টাকাও চাইছেন মুরগির ব্যবসায়ীরা। গত বছর রমজানের আগে কেজি প্রতি ব্রয়লার মুরগির দাম আড়াই শ’ টাকা ছাড়িয়েছিল।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কেবল নির্বাচনের পরেই ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে অন্তত ১০ টাকা বেড়েছে। ফলে গত এক মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৪০ টাকার মতো বেড়েছে। নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের সাধারণ মানুষের প্রাণিজ আমিষের বড় উৎস এই মুরগি। বেড়েছে সোনালি মুরগির দামও। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকায়। মাসখানেক আগে সোনালি মুরগির কেজি ৩০০ টাকার আশপাশে ছিল।
মুরগির দাম বাড়ার জন্য বাচ্চা ও খাবারের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি বাজারে সিন্ডিকেটের কারসাজিকে দায়ী করে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক প্রান্তিক খামারি উৎপাদন থেকে সরে যাচ্ছেন। তাতে বাজারে সরবরাহের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এরই সুযোগ নিচ্ছে একটি চক্র। এরা দাম কমানোর সময়ে সক্রিয় থাকে, আবার মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কলকাঠি নাড়ে। রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে কঠোর তদারকির প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তালিকায়ও উঠে এসেছে যে বাজারে সব ধরনের মাংসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। টিসিবির হিসাবে গত এক মাসে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। গত এক মাসে খাসির মাংসের দামে হেরফের না পেলেও টিসিবির বাজারদর বলছে, ব্রয়লার মুরগির দাম বেশ বেড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে এই বৃদ্ধি ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
বাজারে মাংসের পাশাপাশি ডিমের দামও বাড়তির দিকে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম অন্তত ৫ টাকা বেড়েছে। বাজারভেদে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম এক সপ্তাহ আগে ছিল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। চাহিদার তুলনায় ডিমের সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়ছে—এমন দাবি ব্যবসায়ীদের।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, জানুয়ারিতে স্কুল খুলে দেওয়ার ফলে ডিমের চাহিদা বেশ বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে ডিমের দামে। তবে রমজানে ডিমের চাহিদা সাধারণত কমে যায়। তাই রোজায় ডিমের দাম আর না বেড়ে বরং কমবে বলে মনে করেন তিনি।
মাংসের উৎপাদন কমেছে
এদিকে টানা ৯ বছর বৃদ্ধি পাওয়ার পর দেশে প্রথমবারের মতো মাংসের উৎপাদন কমেছে। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) তার আগের বছরের তুলনায় ৫ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কম মাংস উৎপাদিত হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে দেশে প্রতিবছর মাংসের উৎপাদন বাড়ছিল। গত অর্থবছরই প্রথম উৎপাদন কমেছে। উৎপাদন কমার আগের বছর (২০২১-২২) মাংসের উৎপাদন ছিল ৯২ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর তা কমে দাঁড়ায় ৮৭ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টনে।
গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগিসহ সব ধরনের মাংসের উৎপাদনই কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।