ভালোবাসা দিবসে আরও রঙিন হলো অর্থনীতি
ভ্যালেনটাইনস ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুন তথা বসন্ত উৎসব দুটোই আমাদের মনে রং ছড়ায়। আর মনের সেই রং আমাদের নিয়ে যায় পোশাক–ফ্যাশনের শোরুমে, বিপণিবিতানে এবং ফুলের দোকানে। সাধের সঙ্গে সাধ্যের মিল রেখে আমরা যে যার মতো কেনাকাটা করি, কিছু নিজের জন্য আর কিছু প্রিয়জনদের জন্য। বদৌলতে আমাদের কেনাকাটার রঙে দেশের অর্থনীতিও রঙিন হয়ে ওঠে।
প্রতিবছরই এ দুটি দিবসে দেশের অর্থনীতিতে বাড়তি মূল্য সংযোজন হয়। যেমন বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফাল্গুনে আপনি যে প্রেমের মানুষটি বা প্রিয়জনের জন্য ফুল কিনলেন, পরিবার–পরিজন কিংবা বন্ধু–স্বজনদের নিয়ে বাইরে খেতে গেলেন, অথবা নিজের ও প্রিয়জনদের জন্য নতুন রঙিন পোশাক পরলেন, তাতে কিন্তু নিজের অজান্তেই অর্থনীতিকে বড় করে ফেললেন। কারণ, জনগণের যত অর্থ খরচ হয়, অর্থনীতি তত বড় হয়। ভালোবাসা দিবস বা পয়লা ফাল্গুন উপলক্ষে এখন পোশাক, খাবার, ফুল ব্যবসায়ীদের জন্য ভরা মৌসুম চলছে। করোনার কারণে তাঁদের ব্যবসায়ে মোটামুটি টান পড়েছিল, যা এখন কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন।
ভালোবাসা দিবসে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ফুলের। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ভালোবাসা দিবসের চাহিদা সামনে রেখে ফুলের দামও বেশ বেড়েছে। রাজধানীতে গতকাল একেকটি সাধারণ গোলাপ ৪০ থেকে ৫০ ও চায়না প্রজাতির গোলাপ ৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ ৭ ফেব্রুয়ারিও প্রতিটি সাধারণ গোলাপ ৬–১০ টাকা ও চায়না প্রজাতির গোলাপ ২০–৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। একই সময়ে প্রতিটি জারবেরা, টিউলিপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকাসহ অন্যান্য ফুলের দামও ১৫–২০ টাকা করে বেড়েছে।
ভ্যালেন্টাইনস ডে ও পয়লা ফাল্গুন উপলক্ষে বিশেষভাবে বানানো মাথায় পরার জন্য ফুলের মুকুটও ২০০-৩০০ টাকার কমে মিলছে না। সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহজুড়ে ফুলের জমজমাট ব্যবসা হয়েছে। রাজধানীর অন্যতম বড় ফুলের বাজার শাহবাগের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কোভিডের কারণে ফুলের ব্যবসা কমেছে। তারপরও এ মৌসুমে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার মতো ব্যবসা হবে বলে আশা করছেন তাঁরা।
যশোর, সাভার, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হয়। পয়লা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে এসব জায়গার ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করছেন। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে ফুল পরিবহনে এবং ব্যবসার খুচরা পর্যায়েও মূল্য সংযোজন হয়। এভাবেই ফুলও কয়েক স্তরে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
এবার আসি পোশাক-আশাকের ব্যবসায়। ভ্যালেন্টাইনস ডে ও পয়লা ফাল্গুনে নানা রঙের জামাকাপড় কেনার হিড়িক পড়ে। পোশাকে হলুদ, বাসন্তী, কমলা, লাল রঙের প্রাধান্য থাকে। উপহারের বাক্সও যায় প্রিয়জনদের কাছে। এ জন্য ফ্যাশন হাউসগুলো নতুন নতুন ফ্যাশনের পোশাক নিয়ে আসে। কয়েকটি ধাপে এ কাজ পূর্ণতা পায়। যেমন সুতা থেকে কাপড়; কাপড় থেকে রং কিংবা নকশা; তারপর বাসে-ট্রাকে করে তা শোরুমে নেওয়া। এভাবে প্রতিটি ধাপেই মূল্য সংযোজন হচ্ছে, মানে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে পোশাক-আশাক, প্রকারান্তরে ভালোবাসা।
দেশের অন্যতম বড় ফ্যাশন হাউস আড়ং। এবার পয়লা ফাল্গুন উপলক্ষে প্রতিষ্ঠানটি হালফ্যাশনের সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, টি-শার্ট, বাচ্চাদের পোশাক এনেছে। আবার ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে আড়ংয়ের শোরুমগুলোর তাকে নতুন নতুন পোশাকের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের উপহার পণ্য (শোপিস, মগ, মোমের সামগ্রী ইত্যাদি) উঠেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দামের গিফট কার্ডও বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। আড়ংয়ের মতো দেশের অন্য ফ্যাশন হাউসগুলোও নতুন নতুন বাহারি পোশাকের সমাহার ঘটিয়েছে। তাদেরও বেচাকেনা বেশ ভালো।
জানতে চাইলে ফ্যাশন হাউস মালিকদের সংগঠন ফ্যাশন উদ্যোগের সভাপতি শাহীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতবারের তুলনায় এবার বেচাকেনা তুলনামূলক ভালো। করোনার কারণে গতবার ব্যবসা তেমন একটা হয়নি। এবার গতবারের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি বেচাকেনা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এবার ভালো ব্যবসার আশা নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু কোভিডের অমিক্রন ঢেউয়ের কারণে ব্যবসায় কিছুটা টান পড়েছে।’
ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনকে নিয়ে খেতে যাবেন। এর মাধ্যমেও আপনি অর্থনীতিতে অবদান রাখবেন। ভালোবাসা দিবস রেস্তোরাঁ, ফাস্ট ফুড, কফিশপগুলোতে বাড়তি চাপ থাকে। থাকে বাড়তি আয়োজনও। নানা ধরনের অফার দিয়ে গ্রাহক আকর্ষণের চেষ্টাও চলে। এবারের ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন, ওয়েস্টিন ঢাকাসহ বড় বড় তারকা হোটেলগুলো বুফে ডিনারসহ বিভিন্ন অফার দিয়েছে। আবার ব্যাংকের কার্ডে বিল দিলে ‘একটি কিনলে আরেকটি ডিনার ফ্রি’ পাওয়ার অফারও আছে। এ ছাড়া রাজধানীসহ সারা দেশের বড় শহরগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় ফাস্ট ফুড ও কফিশপগুলোতে ব্যস্ততাও থাকে সারা দিন। সবই কিন্তু দেশের অর্থনীতির জন্য ‘সবুজ সংকেত’।
চলুন এবার ঘুরে আসি বিনোদনজগৎ থেকে। ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো বিশেষ নাটক, গানসহ নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। কয়েকটি স্যাটেলাইট চ্যানেল তো কয়েক দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করছে। এ জন্য ৮০টির বেশি নতুন নাটক বানানো হয়েছে। এ ছাড়া এক শর মতো নাটক ইউটিউবে সম্প্রচার হবে। এসব নাটক ও অনুষ্ঠান বানাতে গিয়ে শিল্পীদের সম্মানী দেওয়াসহ লাইট-ক্যামেরা ও শুটিং স্পট ভাড়া মিলিয়ে নানা খাতে খরচ করতে হয়েছে। আমরা জানি, এভাবে যত খরচ হবে অর্থনীতি তত বড় হবে।
বিশ্বজুড়েই বড় হচ্ছে ‘লাভ ইকোনমি’
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে হইচই একটু বেশি হয়। ফুল কেনার পাশাপাশি প্রিয়জনকে নিয়ে খেতে যাওয়া তো আছে। এ ছাড়া কার্ড, চকলেটসহ উপহারসামগ্রী পাঠানোর পাশাপাশি প্রিয়জনকে নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাওয়া একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে।
গত রোববার ব্রিটিশ গণমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’–এ প্রকাশিত ভালোবাসা দিবসে গোলাপের বাজার নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারে ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে ফুলের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাওয়ার ইন্ডাস্ট্রি অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি আন্না জেবর বলেছেন, গোলাপ ফুলের ডজনপ্রতি দাম বেড়ে ১৪০ ডলারে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ার অনলাইনে ফুল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মি. রোজেস তো ছয়টি গোলাপই বিক্রি করছে ৯৯ ডলারে।
করোনার আগে ২০২০ সালের শুরুতে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেন সেবা প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড ভালোবাসা দিবসের অর্থনীতি নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। ৫৩টি দেশ থেকে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে ‘লাভ ইকোনমি’ বা ‘ভালোবাসার অর্থনীতি’ তুলে ধরা হয় ওই গবেষণায়। তাতে বলা হয়েছে, ভালোবাসা দিবসে আগের তুলনায় বেশি খরচ করছে মানুষ। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এ খরচ বেড়েছে ১৭ শতাংশ। শুধু ১১ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আগের তিন বছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ লেনদেন বেড়েছে।
এবার দেখা যাক, ওই তিন বছরে ফুল ও গয়না বিক্রি কত বেড়েছে। মাস্টারকার্ড বলছে, ভ্যালেন্টাইনস ডে উপলক্ষে ওই সময়ে ফুল বিক্রি ৩ শতাংশ ও গয়না বিক্রি ৬ শতাংশ বেড়েছে। অনলাইনে পণ্য বিক্রি বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। আর শপিংমলে সশরীর গিয়ে কেনাকাটা বেড়েছে ১৭৫ শতাংশ। মাস্টারকার্ড বলছে, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ হচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবদান বাড়ছে।