ভৈরবের পাদুকাশিল্প
ব্যবসার ভরা মৌসুমে কারখানায় নীরবতা
বর্তমানে ছোট–বড় প্রায় ১০ হাজার কারখানা রয়েছে।
৩০০ কারিগর কাজ করেন এমন কারখানা আছে ২০টি।
২০০ শ্রমিক কাজ করেন এমন কারখানা ৩০টি।
বেলা পৌনে একটা। কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর শহরের হাজি মার্কেটের কালাম স্যান্ডেল কারখানা। কারখানাটির কারিগর নয়ন মিয়া (৪২) ভেতরে বসে অলস সময় পার করছিলেন। হাতে কাজ কম থাকায় একই কারখানার অন্যরাও ছিলেন গল্পগুজবের মেজাজে।
শুধু নয়ন মিয়া নন, ঈদ সামনে রেখে ভরা মৌসুমে ভৈরবের পাদুকা কারখানার সঙ্গে জড়িত লাখো কারিগর এখন কর্মহীন। তাঁদের কর্মের সচল চাকা অচল করে দিয়েছে করোনা। এই কারণে ভৈরবের পাদুকাশিল্প খাতে হাজার কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এই ক্ষতির কারণে অভাব স্থায়ী হচ্ছে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরের পরিবারে। এরই মধ্যে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন বেশির ভাগ কারখানার মালিক।
নয়ন মিয়া বলেন, সারা বছর যেমন তেমন, রোজার মাস মানে হাত গরম। দিনরাত কাজ আর পকেট ভরা টাকা। কিন্তু করোনা একদিকে মানুষের প্রাণ নিচ্ছে, অন্যদিকে কেড়ে নিয়েছে তাঁদের কাজ। ফলে এখন পড়েছেন বড় দুর্বিষহ অবস্থায়। অর্থকষ্টে প্রতি বেলার চাল প্রতি বেলায় কিনতে হচ্ছে।
ভৈরব পৌর শহরের কমলপুর এলাকার তিন কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে তিন হাজারের বেশি জুতার কারখানা। সবখানেই নীরবতা। কাজ নেই।
হাজি মার্কেটের অবস্থান ভৈরব উপজেলা পরিষদ ভবনের বিপরীতে। এই এক মার্কেটেই জুতার কারখানা রয়েছে প্রায় ৫০০টি। সম্প্রতি মার্কেটটি ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ কারখানায় তালা ঝুলছে। কিছু কারখানা খোলা থাকলেও কাজ নেই। কয়েকটিতে কাজ হচ্ছে সীমিত পরিসরে। কাজের ভরা মৌসুমে মার্কেটজুড়েই একধরনের নীরবতা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, স্বাধীনতার কয়েক বছর পর থেকে ভৈরবে পাদুকাশিল্পের সূচনা হয়। তাতে গতি আসে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। বর্তমানে ছোট–বড় প্রায় ১০ হাজার কারখানা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৩০০ কারিগর কাজ করেন এমন কারখানা আছে ২০টি। আর ২০০ শ্রমিক কাজ করেন এমন কারখানা ৩০টি। বড় কারখানাগুলোতে জুতা তৈরি হয় সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায়। বাকি কারখানাগুলোতে কাজ হয় হাতে। ভৈরবে উৎপাদিত জুতা রপ্তানিও হয়। জুতার কারখানার পাশাপাশি সহায়ক কারখানা ও দোকান রয়েছে আরও হাজারখানেক।
অতীতেও এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নানা ধরনের সংকটের মুখে পড়েছেন। তবে এবার করোনার কারণে দেখা দেওয়া সংকট এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে। ভরা মৌসুমে পরপর দুবার ব্যবসায় বড় ধরনের মার খেতে হয়েছে। ভৈরবের জুতার ব্যবসার মৌসুম মূলত ঈদুল ফিতর নির্ভর। ঈদের দুই মাস আগে থেকে শুরু হয় মৌসুম। করোনার কারণে গত বছরের ঈদে ছিল সাধারণ ছুটি। আর এবারও চলছে লকডাউন।
ভৈরব পৌর শহরের কমলপুর এলাকার তিন কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে তিন হাজারের বেশি জুতার কারখানা। হাজি মার্কেটের বাইরে হাজি করিম মিয়া মার্কেট, মিজান মার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, হাজি লাল মিয়া ও কালু মিয়া মার্কেটে গড়ে ১০০টি করে কারখানা রয়েছে। সব কটি মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, সবখানেই নীরবতা। কাজ নেই।
হাজি কালু মিয়া মার্কেটের সামনে কথা হয় জুতার কারিগর হাবিবুর রহমান, কাজল মিয়া ও লোকমান হোসেনের সঙ্গে। প্রত্যেকে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এ পেশার সঙ্গে যুক্ত। আলাপকালে তাঁরা জানান, রোজার মাস শুরু হলে চোখে ঘুম থাকত না। কাজ শেষ করে ভোরে ঘুমাতে যেতাম। তা–ও কয়েক ঘণ্টার জন্য। আর এখন শুয়ে-বসে দিন পার করতে হচ্ছে।
উপজেলার জামালপুর গ্রামের কারখানার মালিক গোলাম রসুলের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। বারবার চিকিৎসকের কাছে গিয়েও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না। গোলাম রসুল জানালেন, কারখানা চালু করতে না পারার দুশ্চিন্তা থেকে তাঁর এ সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারণ, মৌসুম ধরার জন্য স্থানীয় একটি এনজিওর কাছ থেকে চড়া সুদে সাত লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এখন সবকিছু মিলিয়ে তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন।
হাজি মার্কেটের অর্পণা বাক্স হাউস। এই কারখানায় জুতার বাক্স তৈরি হয়। সম্প্রতি কারখানাটিতে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে থাকা পাঁচ শ্রমিকের মধ্যে দুজন কাজ করছেন। বাকি তিনজন বসে গল্প করছিলেন। ব্যবসার হালহকিকত জানতে চাইলে কারখানার মালিক সুজন মিয়া জানান, চাহিদা না থাকায় উৎপাদন চার ভাগের এক ভাগে নামিয়ে এনেছেন।
হাজি করিম মার্কেটের ম্যাটেরিয়াল দোকান জাহিদ ট্রেডার্স। গত সপ্তাহের শেষ দিনে দুপুরে দোকানটিতে দেখা যায়, দোকানি মোজাহিদ মিয়া চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছেন। পরিচয় দিতেই তিনি বলে উঠলেন, ভালা না। খুব খারাপ। এমন মৌসুমে দিনে গড়ে ৭০ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি করতাম। আর এখন দিনে চার হাজার টাকারও বিক্রি হয় না।
করোনার কারণে ভৈরবের পাদুকাশিল্পের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে কথা হয় ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আল আমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো মালিক শুরুর ক্ষতিই পুষিয়ে উঠতে পারেনি, এর মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামাল দিতে ‘লকডাউন’ চলছে। তা–ও আবার ব্যবসার ভরা মৌসুমে। তিনি জানান, বেশির ভাগ ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। কেউ ঋণ নিয়ে বিপদে আছেন। আবার কেউ পেশা বদল করেছেন। এবার যদি মৌসুমটি ধরা না যায়, তাহলে এই খাতের উৎপাদন ক্ষতি হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। ব্যবসা প্রসারের বদলে খাতটি সংকুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।