ভাত ছাড়া সারা দিন আমরা যা যা খাই, তাতে গমের তৈরি খাবারই বেশি। সকালের নাশতায় রুটি-পরোটা, দুপুর-বিকেলে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট, বাসা বা রেস্তোরাঁয় নানা বৈচিত্র্যময় খাবারে মিশে আছে গম। আর উচ্চবিত্ত হলে ভাতের বদলে থাকতে পারে একবেলা রুটি। দুই দশক আগেও গমের রুটি ছিল গরিবের খাবার। রেশনের পণ্য হিসেবে পরিচিত গম এখন কেন সব শ্রেণির মানুষের খাদ্যাভ্যাসে জড়িয়ে গেল?
বয়সের কোটা যাঁদের চার-পাঁচ দশক পেরিয়ে গেছে, তাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী, গমের আটা একসময় ছিল গরিবের খাদ্যতালিকায়। সরকারি রেশন, ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য—নানা কর্মসূচিতে ছিল শুধু গম আর গম। গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট মেশিনে গম ভেঙে আটা তৈরি হতো। সকালের নাশতায় লাল আটার রুটি দিয়ে লাল চা ছিল গরিবের খাদ্যতালিকায়। চাহিদা বেশি ছিল না বলে আমদানিও হতো কম। দেশীয় উৎপাদন আর অনুদানের গম—দুইয়ে মিলে মিটে যেত চাহিদা। আমদানি বলতে ছিল সরকারি খাতে।
তিন দশক আগের কথাই ধরি। খাদ্য বিভাগ জানাচ্ছে, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে খাদ্যসহায়তা হিসেবে ১৫ লাখ ৩০ হাজার টন গম পেয়েছিল বাংলাদেশ। সরকারি আমদানি ছিল ৩০ হাজার টন। আর দেশে উৎপাদন ছিল ১০ লাখ টন। এই ২৫ লাখ ৬০ হাজার টনে ১১ কোটি ১৫ লাখ মানুষের চাহিদা মিটেছে। জনপ্রতি দৈনিক গমের সরবরাহ ছিল ৬৩ গ্রাম। সে সময় সিংহভাগই সরকারি খাদ্য বিতরণ পদ্ধতিতে সরবরাহ কর হতো।
দুই দশক আগপর্যন্ত গমের সরবরাহের বড় অংশই ছিল মূলত খাদ্যসহায়তার ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় কমিশন, কানাডা এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ছিল প্রধান দাতা। আর ১৯৯১-৯২ অর্থবছর পর্যন্ত আমদানিতে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল সরকারের। ১৯৯৩ সালে সরকার বেসরকারি খাতকে গম আমদানির সুযোগ দেয়। প্রথম বছরেই আমদানি সাড়ে তিন লাখ টন ছাড়ায়। প্রায় এক দশকের মাথায় প্রথম অনুদানের গম ছাড়িয়ে আমদানি বাড়ে। এরপর এক মিলিয়ন, দুই মিলিয়ন করে এখন ছয় মিলিয়ন বা ৬০ লাখ টন ছাড়িয়েছে গম আমদানি। অর্থাৎ ধীরে ধীরে বেসরকারি খাতের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে।
স্বাধীনতার আগে দেশে গম উৎপাদিত হতো এক লাখ টনের মতো। স্বাধীনতার পর এক দশকে বেড়ে দশ লাখ টন হয়। ১৯৯৮-৯৯ সালে দেশে গম উৎপাদনে রেকর্ড হয়, সে বছর উৎপাদিত হয়েছিল ১৯ লাখ ৮৮ হাজার টন। এখন উৎপাদন কমছে, আমদানি বাড়ছে। দেশের উৎপাদন দিয়ে বড় জোড় ১০ শতাংশ চাহিদা মিটছে। বেসরকারি খাতে চলে যাওয়ার পর দুই দশকের ব্যবধানে আমদানি বেড়েছে ছয়গুণ। আমদানি আর সামান্য উৎপাদন মিলে এখন দেশে গমের চাহিদা বছরে ৭৫ লাখ টন।
গম আমদানিতে এখন শতকোটি ডলার চলে যাচ্ছে বিদেশে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের টানাপোড়েনে এবার তা ২০০ কোটি ডলার ছাড়াবে। তবে আমদানি বাড়লেও খারাপ নয়। কারণ, গম আমদানি লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করেছে। বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী বিনিয়োগ করছে হাজার কোটি টাকা। সেটি গম থেকে আটা-ময়দার কারখানা হোক বা বিস্কুট-নুডলসের মতো খাদ্যপণ্য কারখানা হোক-দিন শেষে কাঁচামাল গমই। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা বেকারিও আছে এই তালিকায়। আবার গমের তৈরি খাদ্যপণ্যের রপ্তানির বাজারও বড় হচ্ছে। গম ঘিরে শুধু বাণিজ্য আর বাণিজ্য। আমদানি থেকে রপ্তানি, ফুটপাত থেকে অভিজাত রেস্তোরাঁ-সবখানেই গম বা গমের খাবারের বাণিজ্য।
একটু বিশ্ব বাজারে ফেরা যাক। বিশ্বে গম উৎপাদনে শীর্ষ পাঁচ দেশ চীন, ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। বাংলাদেশ এ তালিকায় ৫১ তম অবস্থানে। গম রপ্তানিতে শীর্ষ তালিকায় আছে রাশিয়া-ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও কানাডার মতো দেশ। বাংলাদেশের চাহিদার সিংহভাগ গম আসত রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। নরম গম। আমিষ কম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভারতের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যায়। ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার আগপর্যন্ত (১ মার্চ থেকে ১২ মে) দেশটি থেকেই এসেছে আমদানি করা গমের ৬৩ শতাংশ। কম আমিষযুক্ত গম দিয়ে তৈরি হয় আটা। উচ্চ আমিষযুক্ত গম আসছে কানাডা-অস্ট্রেলিয়া থেকে। উচ্চ আমিষযুক্ত গম থেকে তৈরি হয় ময়দা। দুটো মিশিয়েও ময়দা তৈরি হয়।
গত আট বছরে গমের সরবরাহ ও চাহিদা সবচেয়ে বেশি ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪০ লাখ টন গম সরবরাহ করা হয়। পরের বছর তা বেড়ে ৫০ লাখ টনে উন্নীত হয়েছিল। আর গত ২০২০-২১ অর্থবছরে গমের সরবরাহ ছিল ৭৮ লাখ টন। গম আমদানিতে বৈশ্বিক ক্রমতালিকায়ও এখন পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এত এত গমের তৈরি খাবার খেয়ে কিন্তু গমের ভোগে বিশ্বের সেরা ১৫-তে নেই আমরা। কারণ, গম আমাদের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য।
আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চালের সঙ্গে গমের চাহিদায় অম্ল-মধুর সম্পর্ক দেখা যায়। গরিবের খাদ্যতালিকায় কাটছাঁটের কারণে কখনো গমের চাহিদা বেড়েছে, কখনো বা কমেছে। যেমন, গমের চাহিদা কমলে বেড়ে যায় চালের চাহিদা। কারণ, রুটির বদলে তখন গরিব মানুষ ভাত বেশি খেয়ে দিন পার করে। আবার যখন চালের দাম বেশি বেড়ে যায় তখন গমের খাবারের প্রতি ঝুঁকে গরিব মানুষ। তখন গমের চাহিদা বাড়ে। তবে মধ্যম ও উচ্চমধ্যম আয়ের মানুষের জন্য গমের দামের ব্যবধানে খুব বেশি কিছু যায় আসে না। সেটি ডায়াবেটিস রোগীর জন্যও, যাদের একবেলা ভাতের পরিবর্তে রুটি চাই-ই চাই। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপেও তা–ই আছে। এখন যারা গরিব নয়, এমন লোকজনই বেশি খাচ্ছে গমের তৈরি খাদ্যপণ্য। সেটি বাসায় হোক বা রেস্তোরাঁয়।