সেতু প্রকল্প
গাফিলতির মাশুল ৭৩৫ কোটি টাকা
পটুয়াখালীতে নতুন করা সেতু ভারী যান চলাচলের উপযোগী নয়। ফলে পাশে আরেকটি সেতু নির্মাণ করতে হচ্ছে। সঙ্গে রাস্তাও বানাতে হবে।
পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদের ওপরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) একটি সেতু নির্মাণ করছে। সেতুটির মূল কাঠামোর নির্মাণ শেষ। এখন সংযোগ সড়কের কাজ চলছে। কিছুদিন পরেই এটি উদ্বোধন করা হবে। এই সেতু থেকে ৩ কিলোমিটার পূর্বে আরেকটি সেতু নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। কেন?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা সেতুটি ভারী যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়। পটুয়াখালীর পায়রার গভীর সমুদ্রবন্দর এবং সংলগ্ন অন্যান্য স্থাপনার ভারী যানবাহন পরিবহনের জন্য বাড়তি সক্ষমতার সেতু দরকার। সে কারণেই নতুন আরেকটি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।
উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা সেতুটির নির্মাণকাজ যখন শুরু হয়, তার আগেই পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ এলজিইডিকে চিঠি দিয়ে ভারী যান চলাচলের উপযোগী করে তা নির্মাণের অনুরোধ করেছিল। তাতে কান না দিয়ে এলজিইডি ২০১৬ সালে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে। এখন পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ সওজকে দিয়ে আরেকটি সেতু নির্মাণ করাচ্ছে। ব্যয় হচ্ছে ৭৩৫ কোটি টাকা। আগেরটি নির্মাণে ব্যয় ১২০ কোটি টাকার মতো। নতুন সেতুর সঙ্গে দুই পাড়ে এখন রাস্তাও করতে হবে।
সরকারের সাবেক সচিব ও অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলছেন, এটি আসলে দ্বৈত ব্যয়, যা জনগণের অর্থের অপচয়। দেশে এক সংস্থা অন্য সংস্থার প্রয়োজন ও অবকাঠামোর প্রভাব বিবেচনা না করেই যে উন্নয়ন প্রকল্প নেয়, তার একটি উদাহরণ আন্ধারমানিকের ওপর কাছাকাছি দুই সেতু।
ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, এ রকম ঘটনা এখন দেশের সর্বত্রই ঘটছে। সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল পরিকল্পনা কমিশনের। সেখানেও বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।
সরকারের এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার সমন্বয়হীনতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) মামুন আল-রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজের ধরন প্রায় একই। এ জন্য তাদের মধ্যে কিছুটা সমস্যা হয়। আমরা পরিকল্পনা কমিশন থেকে দুই সংস্থাকে বলেছি, আগামীতে আরও ভালো করে প্রস্তুতি নিয়ে আসতে।’
এক নদীতে তিন সেতু
প্রস্তাবিত সেতুটি নির্মাণ হলে পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদের ওপর মোট সেতুর সংখ্যা হবে ৩। সবকটি সেতু নদের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে। ২০১৬ সালে প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের নামে প্রথম সেতু চালু হয়। এটি পটুয়াখালীকে কুয়াকাটার সঙ্গে যুক্ত করেছে। এর পূর্ব পাশে এলজিইডির সেই সেতু। এটি পটুয়াখালীকে কুয়াকাটার পাশাপাশি পায়রা বন্দর সংযোগ সড়কের সঙ্গেও যুক্ত করবে। এর পূর্ব পাশে একই নদের ওপর প্রস্তাবিত তৃতীয় সেতুটি পটুয়াখালীর সঙ্গে পায়রা বন্দর, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শের–ই–বাংলা নৌঘাটিকে যুক্ত করবে। সওজ এরই মধ্যে সেতুটির দরপত্র আহ্বান করেছে। আগামী জুনের মধ্যে কাজ শুরু হতে পারে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বালিয়াতলী ফেরিঘাটে ৬৭৭ মিটার দৈর্ঘ্যের এলজিইডির করা সেতুটির নাম দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় চার নেতার একজন সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীতে সেতু নির্মিত হলে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। নাব্যতা কমার আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কলাপাড়া আঞ্চলিক কমিটির সদস্যসচিব মেজবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ৮-১০ কিলোমিটার দূরত্বে তিনটি সেতু নির্মিত হলে নদীর পানির প্রবাহে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নদীতে পলির আস্তরণ বাড়বে। তিনি আরও বলেন, আন্ধারমানিক নদ ইলিশের অভয়াশ্রম। এই নদের সঙ্গে অনেক জেলের জীবন-জীবিকা জড়িত। পানির প্রবাহ কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ইলিশ বিচরণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বন্দরের চিঠি, এলজিইডির উপেক্ষা
সরকার পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আট বছর আগে। শুধু বন্দরই নয়, পটুয়াখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয় একই বছর। সমুদ্রবন্দর করতে ভারী যন্ত্রপাতি ও উপকরণ আনা-নেওয়ার জন্য একটি সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল তখনই। একই সময়ে এলজিইডি সেখানে একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু প্রকল্পের পরিচালক রুহুল আমিন খান প্রথম আলোকে বলেন, এলজিইডি গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগের জন্য সেতু নির্মাণ করে। ভারী যানবাহনের জন্য নয়। এলজিইডির তৈরি সেতু দিয়ে সর্বোচ্চ ২০ মেট্রিক টন পরিবহন ক্ষমতার যানবাহন চলতে পারে। তিনি বলেন, ‘পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ যখন আমাদের অনুরোধ করেছিল, তার অনেক আগেই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা হয়ে যায়। তখন আর কিছু করার ছিল না।’
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্দর ও অন্যান্য প্রকল্পে সর্বোচ্চ ৪০ টন ক্ষমতার কনটেইনার আনা-নেওয়া করতে হবে। এখন এলজিইডি যে সেতুটি নির্মাণ করেছে, তা দিয়ে এত ভারী কনটেইনার নেওয়া যাবে না। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপপ্রধান প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুটি ভারী যন্ত্রপাতি চলাচলের উপযোগী করে তৈরি করা হলে নতুন করে আরেকটি সেতু নির্মাণের প্রয়োজন হতো না।
নতুন প্রকল্পেও গাফিলতি
পরিকল্পনা কমিশন থেকে পাওয়া নথি বলছে, ‘পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ’সংক্রান্ত একটি প্রকল্পের আওতায় আন্ধারমানিক নদের ওপর নতুন সেতু নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এই প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। পুরো প্রকল্পের কাজ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় সওজকে দিয়ে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ যে সেতুটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে, সেখানেও গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিস্তারিত সমীক্ষা ছাড়াই সেতুটির দৈর্ঘ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। ব্যয়ও ধরা হয়েছিল অনুমানের ভিত্তিতে। গত বছর দক্ষিণ কোরিয়ার একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা করা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, সেতুর দৈর্ঘ্য বাড়ছে। সঙ্গে খরচও।
জানা গেছে, প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৫০ মিটার। সমীক্ষার পর দৈর্ঘ্য ১৩০ মিটার বাড়াতে হচ্ছে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২৪ কোটি টাকা, যা এখন ৭৩৫ কোটি টাকায় দাঁড়াচ্ছে।
ওদিকে পায়রা বন্দরের জেটির উচ্চতাও বাড়াতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের ব্যয় ৫৩৪ কোটি টাকা বেড়ে ৪ হাজার ৫১৬ কোটিতে দাঁড়াচ্ছে। এই প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মামুন আল-রশীদ বলেন, এই প্রকল্পে প্রথমে বিস্তারিত সমীক্ষা হয়নি। বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। ফলে নকশায় পরিবর্তন এসেছে।
সমন্বয় কেন হয় না
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই নদীতে একাধিক সেতু নির্মাণ না করতে একাধিকবার নির্দেশ দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ৩ জানুয়ারি একনেক সভায় তিনি যত্রতত্র সেতু তৈরি করে নদীর পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না করতে এবং নদী ও খালে যাতে নৌযান চলাচল ও পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সেতুর যথাযথ উচ্চতা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া তিনি যাঁদের গাফিলতির কারণে প্রকল্পের নকশায় ভুল হয়, সময় বেশি লাগে, অর্থের অপচয় হয়, তা চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।
সরকারের এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার সমন্বয় না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখানে মূল কারণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থা তাদের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে তুলে দিতে চায় না। অথচ সব মন্ত্রণালয় সরকারের অংশ। তিনি আরও বলেন, এসব গাফিলতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।