কেমন চলছে আফগানিস্তানের অর্থনীতি 

তালেবানের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ থাকলেও কিছু পদক্ষেপের ফলে দেশটির মুদ্রার দর বেড়েছে।

দ্য আফগানিস্তান ব্যাংক (ডিএবি)
সংগৃহীত

আফগানিস্তান এখন মানবিক সাহায্য হিসেবে শত শত কোটি ডলার পাচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। ফলে চলতি ত্রৈমাসিকে আফগান মুদ্রার দর বেড়েছে। বস্তুত, এই ত্রৈমাসিকে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের মুদ্রার চেয়ে আফগান মুদ্রার দর বেশি বেড়েছে। আফগানিস্তানের মতো দেশের জন্য এভাবে মুদ্রা শক্তিশালী হওয়াকে একটি বিরল ঘটনা বলেই মনে করছে ব্লুমবার্গ। তাদের সূত্র ধরেই খবরটি দিয়েছে ইকোনমিক টাইমস। 

দুই বছর আগে ক্ষমতা দখল করে তালেবানরা। তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ থাকলেও বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে দেশটির মুদ্রার দর বেড়েছে। যেমন: স্থানীয় লেনদেনে ডলার ও পাকিস্তানি রুপির ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি দেশ থেকে বাইরে ডলার নিয়ে যাওয়ার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করায় দেশটির মুদ্রার দর বাড়ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তালেবান সরকার অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং যাঁরা আইন লঙ্ঘন করবেন, তাঁদের কঠোর শাস্তি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। 

প্রবাসী আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয় তারা। ফলে চলতি ত্রৈমাসিকে আফগানিস্তানের মুদ্রা আফগানির দর বেড়েছে ৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে এ বছর আফগানির দর বেড়েছে ১৪ শতাংশ। ফলে চলতি বছর বিশ্বের যেসব মুদ্রার দর সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, তাতে তৃতীয় অবস্থানে আছে আফগানি। এর সামনে রয়েছে কলাম্বিয়া ও শ্রীলঙ্কার মুদ্রা।

২০২১ সালের আগস্ট মাসে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আফগানিস্তানে নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহ দেখা গেছে। দেশটি বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে একরকম বিচ্যুত হয়ে যায়। নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। অর্থনীতির অবস্থাও খুব ভালো নয়। এ ধরনের বাস্তবতায় আফগানির দর কমার কথা; কিন্তু তা ঘটেনি।  

■ চলতি প্রান্তিকে আফগানির দর বেড়েছে ৯%। সব মিলিয়ে এ বছর আফগানির দর বেড়েছে ১৪%। 

■ বিশ্বে এখন মুদ্রার বিনিময় হার বৃদ্ধিতে আফগানিস্তানের সামনে আছে কলম্বিয়া ও শ্রীলঙ্কার মুদ্রা।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে বেকারত্বের হার অনেকটাই বেশি। দেশটির দুই-তৃতীয়াংশ পরিবার মৌলিক পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। 

আফগানিস্তানের বিশ্লেষক কামরান ব্লুমবার্গকে বলেন, ‘হার্ড কারেন্সি নিয়ন্ত্রণের কৌশল কাজে দিয়েছে; কিন্তু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে মুদ্রার উত্থান ক্ষণস্থায়ী হবে। 

মুদ্রাবাজার

আফগানিস্তানে বিদেশি মুদ্রা মূলত মানি চেঞ্জারদের মাধ্যমে লেনদেন হয়, স্থানীয়ভাবে যারা ‘সরাফ’ নামে পরিচিত। এরা সাধারণত বাজারে স্টল স্থাপন করে বা গ্রাম ও শহরে দোকানভিত্তিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কাবুলের উন্মুক্ত বাজার সরাই শাহজাদা কার্যত দেশটির আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যেখানে প্রতিদিন লাখ লাখ ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা হাতবদল হয়। আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে, এই বাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো সীমা নেই। 

আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কারণে আফগানিস্তানে এখন শতাব্দী–প্রাচীন হাওলা মানি ট্রান্সফার–ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রবাসী আয় আনছে। সরাফদের ব্যবসার বড় একটি অংশ হচ্ছে এই হাওলা। 

জাতিসংঘ মনে করে, এ বছর আফগানিস্তানের ৩২০ কোটি ডলার সহায়তা প্রয়োজন; এর মধ্যে ১১০ কোটি ডলার তারা ইতিমধ্যে দিয়েছে। 

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, আফগান অর্থনীতি এ বছর সংকোচনের ধারা থেকে বেরিয়ে আসবে; ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটিতে ২ থেকে ৩ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে। যদিও তারা যেভাবে নারীদের নিপীড়ন করে যাচ্ছে, তাতে বৈশ্বিক সহায়তা কমতে পারে। 

লন্ডনের বিএমআইয়ের ইউরোপবিষয়ক ঝুঁকি কর্মকর্তা অনিতা বসু বলেন, বিদেশি মুদ্রা লেনদেনে কঠোরতা ও খুব ধীরে হলেও বাণিজ্য বৃদ্ধির কারণে আফগানির চাহিদা বাড়ছে। আফগানির মান যেখানে আছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সেখানেই থাকবে। 

বিনিয়োগ

আফগানিস্তানের হাতে নগদ অর্থের স্বল্পতা থাকলেও তাদের হাতে সম্পদের অভাব নেই। দেশটির হাতে যে পরিমাণ লিথিয়াম আছে, তার মূল্য তিন ট্রিলিয়ন বা তিন লাখ কোটি মার্কিন ডলার। এ মাসেই লৌহ, আকরিক ও স্বর্ণের খনি নির্মাণে চীনা, ব্রিটিশ ও তুর্কি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তালেবান সরকার ৬৫০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তেল উত্তোলনের জন্য চীনা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে তালেবানরা। 

এদিকে পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে যে ডলার পাচার হয়, তাতেও আফগান অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডা আফগানিস্তান প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার নিলামে তুলে দেশীয় মুদ্রাকে শক্তি জোগাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র হাসিবুল্লাহ নুরি এ তথ্য জানান। 

মুদ্রার ওপর চাপ কমার কারণে ডলার উত্তোলনের সীমাও বাড়িয়েছে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের ডলার উত্তোলনের সীমা মাসিক ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪০ হাজার করা হয়েছে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ ডলার করা হয়েছে। গত সোমবার এক ডলারের বিপরীতে ৭৮ দশমিক ৫০ ডলার মিলত।  

পরিস্থিতি ভয়াবহ

আফগানিস্তানে নগদ অর্থের সরবরাহ বাড়লেও মানবিক ও আর্থিক পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ।

তালেবানেরা ক্ষমতা দখলের পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির যে ৯৫০ কোটি ডলার রিজার্ভ জব্দ করেছিল, তার মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার তারা ছেড়ে দিতে রাজি হলেও পরে আবার বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তা স্থগিত করে।

জাতিসংঘের সতর্ক বার্তা হলো, চলতি বছর বিদেশি সহায়তা ৩০ শতাংশ কমলে দেশটির মানুষের মাথাপিছু আয় ৩০ শতাংশ কমে ৩০৬ ডলারে নেমে আসবে, অর্থাৎ ২০২০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমবে। 

এদিকে নারীদের ওপর পাইকারি হারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে তালেবান প্রশাসনের ভেতরেই বিভাজন তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের অনেকেই এখন সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার সমালোচনা করছেন। তাঁর নির্দেশে নারীদের পড়াশোনা, কাজ, পার্কে যাওয়া, ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম করা ও পুরুষ সঙ্গী ছাড়া একা একা দীর্ঘ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

এদিকে চলতি ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ইসলামিক স্টেট বা আইএস আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হামলার পরিকল্পনা করছে। এমনকি আইএস আফগানিস্তানেও হামলা চালাচ্ছে; যেমন এক প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর ও মসজিদে হামলা চালিয়েছে তারা। 

জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, আইএস আফগানিস্তানের মাটিতে চীন, ভারত ও ইরানের দূতাবাসে হামলার হুমকি দিয়েছে। 

এই অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে আফগান মুদ্রার দর আবারও পড়ে যেতে পারে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। তালেবানরা দেশের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ হারালে মুদ্রার গায়েও তার আঁচ লাগবে।