অর্থনীতির সংকটের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ কতটা দায়ী
ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর হলেও অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা কাটেনি। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে নানা সংকট। এর বাইরে নেই বাংলাদেশও।
রাশিয়া আক্রমণ করেছে ইউক্রেনে। এতে দুই দেশেরই বহু সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে, হতাহতের তালিকায় আছে বেসামরিক লোকজনও। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অবকাঠামোর। কিন্তু যাঁরা এই দুই দেশের বাসিন্দাই নন, থাকেন দেশ দুটির সীমান্তের বহুদূরে, তাঁরাও যুদ্ধের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। বিশেষ করে যাঁদের আয় অল্প, যেসব সরকারের সামর্থ্য সীমিত, আছে সুশাসনের অভাব, তাঁরাই যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বেশি।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এক হাজার বিলিয়নে এক ট্রিলিয়ন হয়, আর ১০০ কোটিতে হয় এক বিলিয়ন। সেই হিসাবে ক্ষতি ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার। উৎপাদন ক্ষতির এই হিসাব ধনী দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা ওইসিডির। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন ক্ষতি তো আছেই, তবে এখন সবচেয়ে বড় সংকটের নাম মূল্যস্ফীতি।
বিশ্বে তখন চলাচল বন্ধ, ডলারের চাহিদা নেই, আমদানি কমেছে ব্যাপকভাবে, রপ্তানি কমলেও তার গতি কম। তখন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। অন্য কোনো চাহিদা না থাকায় এই আয় এসেছে বৈধ পথেই। ফলে রিজার্ভও বেড়ে হয় সাড়ে চার হাজার কোটি ডলারের বেশি।
জীবনযাত্রায় প্রভাব
অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দুভাবে বিশ্বের মানুষ বেশি সমস্যায় পড়ে গেছে। যেমন খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। সংস্থাটি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে ১১৬টি দেশের ওপর একটি সমীক্ষা করেছে। এই ১১৬টি দেশেই বিশ্বের ৮৭ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। সমীক্ষা অনুযায়ী, এসব দেশের পরিবারগুলোর জ্বালানি খরচ বেড়েছে ৬৩ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১৩ শতাংশ পর্যন্ত। সুতরাং যাঁদের এই পরিমাণ আয় বাড়েনি, তাঁরা সংকটে পড়ে আছেন।
ফলে বেড়ে গেছে জ্বালানি ব্যয়জনিত দারিদ্র্য। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, কেবল জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের ৭ কোটি ৮০ লাখ থেকে ১৬ কোটি ৬০ লাখ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তবে যুদ্ধের কারণে জ্বালানির খরচের খাতে এতটা সংকট হতো না, যদি বিশ্বের দেশগুলো সঠিক নীতি গ্রহণ করত। যেমন কোভিডের সময় জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমানোর যথেষ্ট সুযোগ ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি। বরং অনেক দেশই আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগও বাড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে যাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁদের লক্ষ্য করে সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
জ্বালানির দর বৃদ্ধি ছাড়াও মূল্যস্ফীতি উসকে দিয়েছে সরবরাহ–সংকট ও ডলারের দর। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকব্যবস্থা মূল্যস্ফীতি কমাতে এখন পর্যন্ত নীতি সুদহার বাড়িয়েছে সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি। এতে স্বল্প আয়ের দেশগুলো আরও বেশি সংকটে পড়েছে, ডলারের দরও বেড়ে গেছে। প্রায় সব দেশকেই ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। বিশেষ করে যারা বাজারভিত্তিক বিনিময় হার এত দিন অনুসরণ না করে মুদ্রার মানকে কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল, তারাই বিপদে পড়েছে বেশি। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
বাংলাদেশ কী করেছে
বিশ্বে সর্বশেষ স্বাভাবিক বছর ছিল ২০১৯ সাল। তখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২১৬ কোটি ৫১ লাখ ডলার। এরপরই দেখা দেয় কোভিড। মহামারির শুরুতেও রিজার্ভ ছিল প্রায় একই রকম। তারপরে কোভিডের দুই বছরে রিজার্ভ বড় একটা লাফ দিয়েছে। বিশ্বে তখন চলাচল বন্ধ, ডলারের চাহিদা নেই, আমদানি কমেছে ব্যাপকভাবে, রপ্তানি কমলেও তার গতি কম। তখন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। অন্য কোনো চাহিদা না থাকায় এই আয় এসেছে বৈধ পথেই। ফলে রিজার্ভও বেড়ে হয় সাড়ে চার হাজার কোটি ডলারের বেশি।
আবার গত প্রায় ১০ বছরেই ডলারের বিনিময় মূল্য রাখা হয়েছিল ৮৬ টাকার আশপাশে। চাপ ও চাহিদা থাকলেও ডলারের এই দর ধরে রাখা হয় কৃত্রিমভাবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে ভালো অবস্থানে থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার অবমূল্যায়ন করেনি। তখন মূল্যস্ফীতিও ছিল সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যেই। এর সঙ্গে অর্থনীতিতে ছিল আরও কিছু বড় সমস্যা, যা এক দিনে তৈরি হয়নি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নাজুক ব্যাংক খাত, উচ্চ খেলাপি ঋণ, জ্বালানি খাতকে পুরোপুরি আমদানির্ভর করা এবং জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) তুলনায় সর্বনিম্ন রাজস্ব আয়। এই তিন বিষয়ে উন্নতি বা সংস্কারের কোনো চেষ্টাও ছিল না।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, অর্থনীতির এসব দুর্বলতা ও ভুল নীতির কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমস্যা বেড়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত ডলারের অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে ২০ শতাংশের বেশি। রিজার্ভ কমে গেছে দ্রুত। উৎপাদন হয়েছে ব্যাহত।
জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আয় কম থাকায় সরকার ভর্তুকি ব্যয় বজায় রাখার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। ফলে দফায় দফায় বাড়ানো হয় সব ধরনের জ্বালানি ও পরিষেবার দর। এতে দেশে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। অথচ উন্নত দেশগুলো জ্বালানি খাতে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবে বিশেষ সহায়তা দিচ্ছে।
একই সময়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকও মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার করেনি। এতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে, খেলাপি ঋণও বেড়েছে। এ সময়ে ব্যাংক খাতে সুশাসনও প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। ফলে প্রভাবশালীদের চাপে নামে-বেনামে ঋণ নেওয়া বেড়েছে। ফলে ভালো ব্যাংকও এখন চরম আর্থিক সংকটে, যার সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে এখন ঋণ নিতে হচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশ কী ধরনের সংস্কার শেষ পর্যন্ত করবে এবং এর প্রভাব সাধারণ মানুষের কতটা পড়বে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। কেননা আইএমএফ ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছে।
রাজস্ব বৃদ্ধির শর্তও দেওয়া আছে, তবে শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী ও যারা কর ফাঁকি দেয়, তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা নিয়েও আছে প্রশ্ন। আবার চলতি বছরের শেষেই জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। এ সময় কৃচ্ছ্রসাধনের পরিবর্তে জনতুষ্টিমূলক প্রকল্প গ্রহণ এবং ব্যাংকঋণ বাড়ানোর চাপও থাকবে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মত
জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ও ডলারের সংকট তৈরি করেছে। যদিও যুদ্ধের আগে থেকেই এই দুই ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। কেননা, কোভিডের পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাস, সারসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। ইউক্রেন যুদ্ধ সেই দাম বৃদ্ধিকে আরও উসকে দিয়েছে। তাই এখানকার উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির জন্য পুরো দোষ ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর দেওয়া ঠিক হবে না।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘ডলারের সংকট মোকাবিলায় আমরা প্রথমে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য আমদানির চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি। আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আবার রপ্তানি, আমদানি ও রেমিট্যান্স—এসবের জন্য ডলারের আলাদা দাম নির্ধারণ করা হলেও দাম সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এটা না করে বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেই বরং ডলারের জোগান বাড়ত। এ ছাড়া সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কত টাকা সাশ্রয় হয়েছে, তা জানি না। অর্থনীতিতে এর প্রভাব দেখছি না।যেমন চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে শুধু বিদেশি সহায়তার অর্থ কমানো হয়েছে। এটি উল্টো কাজ হয়েছে। অর্থনীতির এই সময়ে বিদেশি সহায়তা পুরোটা ব্যবহার করা উচিত ছিল। দেশজ উৎসের অর্থ কাটছাঁট করলে ভালো হতো। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম কমেছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম বেড়েছে, তখন স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম অনেক বাড়ানো হয়েছিল। এখন কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই।’
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইউক্রেন যুদ্ধ দুভাবে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি এ নিয়ে বলেন, প্রথমত, আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ গতি–প্রকৃতি জানা যাবে। যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব থেকে যাবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি কেমন হবে। প্রথম দিকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বড় ধরনের মন্দার শঙ্কা করা হয়েছিল। এখন সেই শঙ্কা কিছুটা কমেছে।
বলা হয়েছিল, শীতে ইউরোপজুড়ে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাবে। তখন ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনীতিতে একধরনের শ্লথগতি আসবে। কিন্তু শীত প্রায় শেষের দিকে। ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাসের উৎপাদন কমেনি। এর ফলে মন্দা এড়াতে ইতিবাচক ধারায় ফিরছে ইউরোপের দেশগুলো।
দেশের অর্থনীতিতেও দুটি শঙ্কা আছে বলে জানান জাহিদ হোসেন। যেমন শীত শেষ হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কেমন হয়, তা দেখার বিষয়। যদি লোডশেডিং বাড়ে, তাহলে অর্থনীতি আবার ধাক্কা খাবে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, ছয় মাসের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা ঠিকমতো কাজ করেনি। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও উত্তপ্ত হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে নতুন যে শঙ্কা যুক্ত হচ্ছে, তা হলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।