দক্ষতার অভাবে পিছিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন
১০ বছর ধরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ৮০–৮৫ শতাংশের ঘরে। এ হার বৃদ্ধিতে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
দেশের জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন একই জায়গায় আটকে আছে। প্রতি অর্থবছরেই বিশাল আকারের বাজেট দেওয়া হয়। ৯ মাস শেষে একবার সংশোধন করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাস্তবায়নের হার আরও কম। তিন বছর ধরে ঘোষিত বাজেটের চেয়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা কম ব্যয় হচ্ছে। অর্থাৎ বাজেটের অর্থ ব্যয় করতে পারছে না সরকার।
অর্থ বিভাগের ১০ বছরের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, প্রতিবারই বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটও পুরোটা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সংশোধন করে এরই মধ্যে তা ৭ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, শেষ পর্যন্ত এ বাজেটও বাস্তবায়ন হবে ৮৫ শতাংশ, যা পরিমাণের দিক থেকে দাঁড়াবে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা।
উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে সমীক্ষা না করা, যোগ্যতম সরকারি কর্মচারীকে যথাযথ পদে নিয়োগ না দেওয়া, সরকারি কর্মচারীদের অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি করা এবং বাস্তবতাবিবর্জিত উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের প্রাক্কলন—এসব বিষয়কে বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এদিকে বাজেট বাস্তবায়নের অদক্ষতার কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতও কম বরাদ্দ পাচ্ছে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যদিও অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকই দেদার অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। আর ব্যয় হচ্ছে অনুন্নয়ন খাতের প্রায় সব বরাদ্দ।
একাধিক বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এমন দুজন সাবেক অর্থসচিব বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরাও বললেন, বাস্তবতার সঙ্গে সংগতির পরিবর্তে বরং ঘাটতির সঙ্গে সংগতি রেখে অনুমাননির্ভর বাজেট তৈরি করা হয় বলেই বাস্তবায়নের হার কম। তাঁরা আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেন, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সুপারিশকে আমলে না নেওয়া। আইএমইডির প্রতিবেদনে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে।
মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যেহেতু আগে থেকেই আঁচ করতে পারে সামনে তাদের কী কী কাজ আছে, ফলে বাজেট পাসের আগে থেকেই তারা কাজটা এগিয়ে রাখতে পারে। বাজেট পাসের পর কার্যপত্র ও দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করতে পারে। এতে বাজেট বাস্তবায়ন হার বাড়বে।সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব—মূলত এ দুই কারণে বাজেটের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত (এডিপি) প্রকল্পগুলো অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে যতটুকু বাস্তবায়িত হয়, পরের তিন মাসেই হয় তার সমান। এতে কয়েকভাবে ক্ষতির শিকার হয় দেশ। একদিকে কাজের মান ঠিক থাকে না, অন্যদিকে খরচ বেড়ে যায়।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যেহেতু আগে থেকেই আঁচ করতে পারে সামনে তাদের কী কী কাজ আছে, ফলে বাজেট পাসের আগে থেকেই তারা কাজটা এগিয়ে রাখতে পারে। বাজেট পাসের পর কার্যপত্র ও দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করতে পারে। এতে বাজেট বাস্তবায়ন হার বাড়বে।
উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদে নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আগামী ৬ জুন প্রথমবারের মতো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন।
বাজেট বাস্তবায়নের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা হয় না বললেই চলে। আর দুঃখজনকভাবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনগুলো জনগণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করা হয় না।
বিশ্বব্যাংক বলছে, তথ্য উন্মুক্ত নয়
বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতা নিয়ে ব্যতিক্রম ছাড়া ভালো কোনো গবেষণা নেই দেশে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সরকার একটি গবেষণা করে গত বছর। ২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ‘সরকারি খরচ ও আর্থিক জবাবদিহি (পিইএফএ) মূল্যায়ন ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নের প্রধান দুর্বলতার সঙ্গে জড়িত মূলত বাজেট প্রস্তুতি, জবাবদিহি ও বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি। এ কারণেই মূল বাজেট থেকে বাস্তবায়িত বাজেটের ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। রাজস্ব আয় ও ব্যয়—দুই দিক থেকেই মূল বাজেটের সঙ্গে হেরফের হয় অঙ্কের। আর সরকার খুব কম তথ্যই জনগণের জন্য প্রকাশ করে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারের অআর্থিক সম্পদের তথ্য পুরোপুরিভাবে তুলে ধরা হয় না। এ ছাড়া বাস্তবায়ন পর্যায়ে যথাযথ নিরীক্ষা হয় না, যা করা হয় তা-ও আবার ঝুঁকিভিত্তিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে হয় না। যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় না রাজস্ব সংগ্রহের তথ্যও। এদিকে বাজেট বাস্তবায়নের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা হয় না বললেই চলে। আর দুঃখজনকভাবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনগুলো জনগণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করা হয় না।
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বেতন-ভাতা, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ ইত্যাদি পরিচালন ব্যয় তো করতেই হয়। এর কোনো বিকল্প নেই। তবে বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার মূল দায়টা আসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত (এডিপি) প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে। তারপর আছে অপচয়, ব্যয় করার সক্ষমতার অভাব, অনভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগ, অর্থের সংকট ইত্যাদি। বাস্তবায়নে গতি আনতে প্রায় ১০ বছর আগে একবার ‘পিডি পুল’ করা হয়েছিল। সেটি আর কার্যকর নয় বলে শুনেছেন বলে তিনি জানান। তাঁর মতে, এটি কার্যকর করা উচিত।
বেতন-ভাতা, দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ ইত্যাদি পরিচালন ব্যয় তো করতেই হয়। এর কোনো বিকল্প নেই।সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ
কম এডিপি বাস্তবায়নই কি দায়ী
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন হার ৮০ শতাংশের ঘরে থাকলেও অনুন্নয়ন বা পরিচালন বাজেটের বাস্তবায়ন হার ঠিকই ৯০ শতাংশের বেশি হয়। উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়নও আবার তাড়াহুড়া করে হয় শেষ দিকে। যেমন গত ছয় অর্থবছর আগে থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতি অর্থবছরেই প্রথম ৯ মাসে উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন হয় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। পরের তিন মাসে হয় বাকিটা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিপির বাস্তবায়ন হার ছিল ২২ শতাংশ।
বাজেট বাস্তবায়ন পুরোপুরি হবে কীভাবে? বাজেট প্রণীত হচ্ছে কি বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে নাকি ঘাটতির সঙ্গে সংগতি রেখে? আইএমইডির প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো কি আমলে নেওয়া হয়?সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) ও অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮২ দশমিক ১১ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯২ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৪ দশমিক ১৬ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তবায়ন ব্যর্থতার কারণগুলো নিয়ে সংসদে তেমন আলোচনাও হয় না। অথচ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করতে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ তৈরি, কর্মসংস্থান তৈরি ও আয় বৃদ্ধির জন্য অন্যতম অনুঘটক হচ্ছে এডিপির বাস্তবায়ন। এডিপির বাস্তবায়ন পিছিয়ে থাকলে পুরো বাজেটের বাস্তবায়নই পিছিয়ে পড়ে।
সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) ও অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীর প্রশ্ন, বাজেট বাস্তবায়ন পুরোপুরি হবে কীভাবে? বাজেট প্রণীত হচ্ছে কি বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে নাকি ঘাটতির সঙ্গে সংগতি রেখে? আইএমইডির প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো কি আমলে নেওয়া হয়?
মুসলিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর অদক্ষতা তো আছেই, আছে অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তি পিডি হিসেবে নিয়োগ না পাওয়া ও জমি অধিগ্রহণে জটিলতা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আলোচনায় আসে না, সেটি হচ্ছে অননুমোদিত প্রকল্প। অননুমোদিত প্রকল্পের তালিকাও কম বড় নয়। তিনি বলেন, তদবিরের তোড়ে এগুলো অনুমোদিত হয় এবং বছরের মাঝামাঝি সময়ে থোক বরাদ্দ থেকে অর্থ স্থানান্তর করে এগুলোর নামে দেওয়া হয়। এই করতে করতে অর্থবছর শেষ হয়ে যায়, কিন্তু খরচ আর হয় না। বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে এসব জিনিসও দূর করা দরকার।