দেশে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবসায়ীরা
আজ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। প্রতি মাসে কোরিয়া ও চীনা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সফররত দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল। আজ মঙ্গলবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংয়ের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি এই প্রতিশ্রুতি দেয়। বাসসের প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়।
বাসসের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোরিয়ান প্রতিনিধিদলে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক, লজিস্টিকস, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের কয়েকটি কোম্পানির প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তাঁরা গত সোমবার চট্টগ্রামে কোরিয়ান ইপিজেড পরিদর্শন করেন।
কোরিয়ান ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এমন সময় আপনারা বাংলাদেশে এসেছেন, যখন আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করছি। এই নতুন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ এখন সহজ ও ঝামেলামুক্ত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের জন্য বিনিয়োগপ্রক্রিয়া সহজ করা আমাদের দায়িত্ব। আমি জানি, গত ১৬ বছরে আপনাদের অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়েছে, আমরা সেই সময়ের ক্ষতিপূরণ দিতে চাই।’
বৈঠকে কিহাক সাং বলেন, ইয়াংওয়ান করপোরেশনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটি টেক্সটাইল ও ফ্যাশন কলেজ স্থাপন করা হবে। এটি বাংলাদেশকে শীর্ষ টেক্সটাইল হাবে পরিণত করতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করবে।
কোরিয়ান প্রতিনিধিদল ছাড়া চীনের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের সঙ্গেও এদিন পৃথক বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়। প্রেস উইং জানিয়েছে, ৩০ সদস্যবিশিষ্ট চীনা ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মেইনল্যান্ড হেডগিয়ার কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট পলিন এনগান। প্রতিনিধিদলে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পরিবহন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বস্ত্র, টেলিযোগাযোগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা রয়েছেন।
চীনা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আট মাস ধরে আমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ সহজ করার লক্ষ্যে কাজ করছি। দেশে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এত অনুকূল পরিবেশ আগে কখনো ছিল না।’ তিনি বলেন, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান প্রতি মাসের ১০ তারিখে কোরিয়া ও চীনা বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠকের আয়োজন করবেন।
চীনা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মোংলায় পরিকল্পিত চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। কয়েকটি চীনা কোম্পানি ইলেকট্রনিক ভেহিক্যাল ট্রানজিশন, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি উৎপাদন, উইন্ড টারবাইনের মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস এবং অফশোর ফটোভোলটাইক সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখায়।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫’ শীর্ষক চার দিনের বিনিয়োগ সম্মেলন গত সোমবার শুরু হয়েছে। এই সম্মেলন উপলক্ষে কোরিয়া ও চীনা বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছে। আগামীকাল বুধবার সকালে এই সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এতে বিশ্বের ৫০টি দেশের ৫৫০ জনের বেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীরা
বিনিয়োগ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ আজ চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ৩৬ বিনিয়োগকারী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা আড়াইহাজারের বিএসইজেড পরিদর্শনে যান। জাপানি ব্যবসায়ীরা পরিচালনা করায় এই বিএসইজেড জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল নামেও পরিচিত।
প্রতিনিধিদলটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে পৌঁছালে প্রথমেই তাদের অর্থনৈতিক অঞ্চলের অবকাঠামো ও অন্যান্য সুবিধা সম্পর্কে ধারণা দেয় বিএসইজেড কর্তৃপক্ষ। এরপর সেখানে অবস্থিত সিঙ্গারের কারখানা ঘুরে দেখেন বিনিয়োগকারীরা।
বিএসইজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারো কাওয়াচি বলেন, মাত্র ২০ মাস সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ করেছে সিঙ্গার। তারা বিনিয়োগ করেছে ৭ কেটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। কারখানাটিতে এখন মাসে ৫০ হাজার ফ্রিজ ও ১০ হাজার টেলিভিশন তৈরি হচ্ছে। তিনি জানান, কাঁচামাল আমদানির সুবিধার্থে বিএসইজেডের ভেতরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের ব্যবস্থা রয়েছে।
বিএসইজেড পরিদর্শনে ছিলেন চীনের ১০ জন, জাপানের ৩, সৌদি আরবের ৩, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৩, যুক্তরাষ্ট্রের ৮ ও ভারতের ১ জন। এ ছাড়া বিদেশে বসবাস করেন, অর্থাৎ অনাবাসী বাংলাদেশি (এনআরবি) ছিলেন আটজন।
চীনা তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জিনিউ বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিকোলাস কী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনেক সম্ভাবনা। অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। এর মধ্যে অন্যতম বড় বাধা হচ্ছে সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা না থাকা। তবে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করি, তারা পরবর্তী সময়েও নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।’
বিনিয়োগ করবে সুইডেনের কোম্পানি
সুইডেনের মালিকানাধীন নিলর্ন বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান বিএসইজেডে বিনিয়োগের করবে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি আজ বিএসইজেড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি এমওইউ বা সমঝোতা চুক্তি করেছে।
নিলর্ন বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোকে জানান, ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তাঁদের একটি কারখানা আছে। এখন তাঁরা পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম উৎপাদনের জন্য বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। তাঁরা ধাপে ধাপে ১ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবেন। এই প্রকল্পে প্রায় ৩০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে এনডিবি
চলতি বছর বাংলাদেশে ব্রিকস গঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চায় বলে জানান বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী।
আশিক চৌধুরী বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে আজ দেখা করেছেন এনডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির কাজভিকোভ। ইতিমধ্যে এনডিবি ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে তারা খুবই ইতিবাচক। এই বছর এনডিবি ১০০ কোটি ডলার অর্থায়ন করতে চায়। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি খাতেও এনডিবি বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। আমরা তাদের আর্থসামাজিক অবকাঠামোতে অর্থায়নের আহ্বান করেছি। হাসপাতাল, আবাসনের মতো প্রকল্পে অর্থায়নের ঘাটতি রয়েছে।’
বিনিয়োগ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন শেষে আজ বিকেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও বিডার নির্বাহী সদস্য খন্দকার আজিজুল ইসলাম।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘বিনিয়োগ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য অনেকগুলো বিনিয়োগ নিশ্চিত কিংবা প্রতিশ্রুতি আনা নয়। আমি সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করি, একটা সম্মেলনে এসে কেউ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন না। বিনিয়োগকারী একটি জার্নির মধ্য দিয়ে যান। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের মধ্যে যে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, সেটি ভেঙে দেওয়া।’