কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত দিন বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করেছে। নিজের স্বাধীনতা ব্যবহার না করে আইনকানুনও তৈরি করেছে তাদের স্বার্থে। বাছবিচার না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে। আর নীতি-পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাটি সব সময় তাকিয়ে ছিল ওপর মহলের দিকে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সারা দেশের মানুষ যখন জর্জরিত, তখনো গুটিকয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে ব্যাংকের সুদের হার বাড়ায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গতকাল সোমবার ঢাকার ধানমন্ডিতে সংস্থাটির কার্যালয়ে ‘ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনা, শিগগির কী করতে হবে’ শীর্ষক পর্যালোচনায় এসব কথা বলেছে। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অর্থাৎ ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। অন্যদিকে এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ২০০৯ সালে ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।
আর্থিক খাতের দুর্নীতির শ্বেতপত্র তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে ব্যাংক খাতের জবাবদিহি।মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ব্যাংক খাত নিয়ে সংস্থাটির পর্যালোচনা তুলে ধরেন। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সিপিডির সুপারিশ, ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানের জন্য ব্যাংক কমিশন গঠন করা। এ কমিশন তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করবে।
সিপিডি বলেছে, নিয়মবহির্ভূত চর্চা, কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি ও চুরি নিয়ে ব্যাংক খাত এখন অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে। বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার আমলে রাজনৈতিকভাবে লাইসেন্স পাওয়া তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের কিছু ব্যাংক মৃতপ্রায় হয়ে আছে। জনগণের করের টাকায় এসব ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে মরতে দেওয়া উচিত। এর বাইরে কিছু ব্যাংক আছে তাদের কার্যক্রম খারাপ, আরেকটু ধাক্কা লাগলেই সেগুলোও মরে যাবে।
সিপিডির মতে, চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের হাতেই সাতটি ব্যাংক। এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। একসময় ইসলামী ব্যাংক একটা ভালো ব্যাংক ছিল। এস আলমের দখলের পরে সেটি মুমূর্ষু হয়ে গেছে। এ ছাড়া একক গ্রাহকের জন্য ঋণসীমা নীতি লঙ্ঘন করে জনতা ব্যাংক এননট্যাক্স গ্রুপকে দিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আর্থিক খাতের দুর্নীতির শ্বেতপত্র তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে ব্যাংক খাতের জবাবদিহি।
সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ। একইভাবে বিমা খাতও অগ্রহণযোগ্য অবস্থায় রয়েছে।
অনুষ্ঠানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্তিরও সুপারিশ করেছে সিপিডি। এ বিষয়ে সাংবাদিক জানতে চান বিভাগটি বন্ধ হয়ে গেলে সেটির আওতায় থাকা ব্যাংক ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদ সদস্য নিয়োগসহ অন্যান্য কাজ তাহলে কে করবে? জবাবে ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থ বিভাগ করবে।
সুশাসনে যত বাধা
ব্যাংক খাতের সুশাসনের পথে চার ধরনের সমস্যা বিদ্যমান বলে উল্লেখ করেছে সিপিডি। এগুলো হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক, প্রশাসনিক (রেগুলেটরি), আইনগত ও তথ্য সম্পর্কিত।
সংস্থাটি বলেছে, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার মধ্যে রয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক যোগাযোগের ভিত্তিতে ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ এবং ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধের খারাপ উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও ঋণ পুনঃ তফসিল করা, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে নিয়ম পরিপালনে ব্যর্থতাও রয়েছে।
সিপিডির মতে, প্রশাসনিক সমস্যার মধ্যে প্রথমেই রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা প্রয়োগের অভাব। এ স্বাধীনতা খর্ব হতে হতে প্রায় হারিয়ে গেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগটি গঠন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করতে। খেলাপি গ্রাহকদের প্রতি নমনীয়তা দেখিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে বাছবিচার ছাড়া ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে।
সিপিডির মতে, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থে একের পর এক ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হয়েছে। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালত আইনেরও দুর্বলতা রয়েছে। ফাঁকফোকর আছে দেউলিয়া আইনেও।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, অনেক সময় সঠিক দেওয়া হয় না। যে তথ্য দেওয়া হয় তার মানও প্রশ্নবিদ্ধ। এসব তথ্য নিয়ে নীতি প্রণয়ন করা কষ্টকর। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংকঋণ দেওয়া হয়েছে।
৩৩ সুপারিশ
ব্যাংক খাতের জন্য ছোট-বড় ৩৩টি সুপারিশ করেছে সিপিডি। সংস্থাটি বলেছে, মৃতপ্রায় ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। একীভূত করার দরকার হলে করতে হবে যথাযথ নিরীক্ষার পর। একীভূত হওয়ার পর দুর্বল ব্যাংকের কাউকে পর্ষদে বসতে দেওয়া যাবে না। ব্যাংকের পর্ষদ নিয়োগ করতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।
১৫ বছরে ২৪ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে যে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, তার পেছনে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বন্ধ করতে হবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগান দেওয়া। এমন নীতি করতে হবে, যাতে ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও আমানতকারীরা তাঁদের পাওনা ফেরত পান।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সাত বছরে (২০০৭-২০১৪) দেশ থেকে ৪৭ থেকে ৬৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এ অর্থ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) শক্তিশালী করার সুপারিশ করা হয়। গত ১৫ বছরে যত গভর্নর ছিলেন, তাঁদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহির আওতায় আনারও সুপারিশ করেছে সিপিডি।
এ ছাড়া মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করা, দেউলিয়া আইন সংশোধন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তি, বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদে এক পরিবার থেকে একজনকে তিন বছরের জন্য এবং সারা জীবনের জন্য দুবার পর্ষদ সদস্য হওয়ার সুযোগ রেখে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, একটি গ্রুপের এক কোম্পানি খেলাপি হলে অন্য কোম্পানিকেও খেলাপি ব লে গণ্য করার বিধান পুনরায় চালু, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের যাবতীয় তথ্য প্রকাশ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মান অনুযায়ী খেলাপি তালিকা করা ইত্যাদি।