বাংলাদেশের ঋণমান কমাল এসঅ্যান্ডপি
বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঋণমান যাচাইকারী কোম্পানি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ঋণমান ‘বিবি মাইনাস’ থেকে কমিয়ে ‘বি প্লাস’ করেছে। দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে, সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের ঋণমান কমানো হয়েছে।
এক বিবৃতিতে এসঅ্যান্ডপি বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির বহিস্থ খাত ধারাবাহিকভাবে চাপের মুখে আছে। বিশেষ করে তারা বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদি ঝুঁকি থাকলেও দেশের মানুষের মাথাপিছু প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার শক্তিশালী থাকায় বাংলাদেশ–সংক্রান্ত পূর্বাভাস স্থিতিশীল রেখেছে এসঅ্যান্ডপি।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বিশ্বের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের একটি। অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান—মুডিস ও ফিচ রেটিংস আগেই বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়েছিল।
সংবাদে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জুন মাসের শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেতে পারে; কিন্তু চলতি জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা দেখা দেয়, তার রাশ টানতে সরকার কারফিউ জারি করে ইন্টারনেট বন্ধ রাখে। এর প্রভাবে দেশের রিজার্ভ কমতে পারে বলে মনে করছে এসঅ্যান্ডপি। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে।
গত ১৯ জানুয়ারি রাতে জারি করা কারফিউ এখনো চলছে। যদিও তা শিথিলের সময় বর্তমানে বাড়ানো হয়েছে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। কারখানায় উৎপাদন এবং আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমও পুনরায় চালু হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন এফআইসিসিআইয়ের প্রাথমিক হিসাবে, কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধের জেরে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার হতে পারে।
ব্লুমবার্গের সংবাদে বলা হয়েছে, ঋণমান কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক অবস্থান নেবে। তারা মনে করছে, সরকার মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ–পদ্ধতি এবং সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের গতি কমবে। তবে এর ফল পেতে সময় লাগবে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল ঋণমান কমানোর অর্থ হলো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ঋণমান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করল। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে এখন একই চোখে দেখছে।
তবে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল যে সময়ে তাদের সিদ্ধান্ত জানাল, তা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এই নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, তাদের এই ঘোষণা এমন সময় এলো যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঘটনা ঘটছে। সে কারণে এর বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটি দেশের ঋণমানের অবনমন হলে সাধারণত ঋণের সুদের হার বাড়ে, ঋণপত্র নিশ্চিত করার খরচ বৃদ্ধি পায় এবং ঋণ করার জন্য যে নগদ অর্থ জমা রাখতে হয়, তার হার বাড়ে। এ ছাড়া ওই দেশের ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা সম্পর্কে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগও কমে।
সর্বশেষ যে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করেছিল, সেটি হলো ফিচ রেটিংস। গত মে মাসের শেষ দিকে তারা আট মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়। তখন প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) ‘বিবি মাইনাস’ থেকে ‘বি প্লাস’ করে, যদিও দেশের অর্থনীতি-সম্পর্কিত পূর্বাভাস স্থিতিশীল রাখে তারা।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালও বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করতে পারেন এমন আশঙ্কা ছিল বলে জানান আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি একচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, দেশের বহিঃস্থ খাতের অবস্থা দুর্বল। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে বিক্ষোভ হয়েছে এবং তার জেরে পুরো দেশকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। বাংলাদেশকে নিয়ে আমাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদারদের যে শঙ্কা রয়েছে, এ ঘটনা তা আরও জোরালো করবে।’
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঋণমান কমিয়ে দেওয়ার ফলে বৈদেশিক ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে আমাদের যেহেতু সভরেন বোরিং নেই, তাই এর প্রভাব খুব বেশি পড়বে মনে হয় না।