বছরজুড়েই বাজারে গিয়ে নিত৵পণ্যের দাম নিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। প্রায় প্রতিটি পণ্যের দামই কমবেশি বেড়েছে। বাজার খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। টানা ৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে।
এত দীর্ঘ সময় ধরে দেশে এমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি গত এক দশকে দেখা যায়নি। বছর শেষে এসেও মূল্যস্ফীতির আঁচে নাকাল হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ ২০২৩ সালকে হয়তো জীবনযাপনের জন্য বিভীষিকাময় বছর হিসেবেই মনে রাখবেন।
গত এক বছরে হঠাৎ করে একেক পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এতে বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। যেমন ডিম, মাংস, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, চিনি—এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষকে বেশ ভুগিয়েছে। প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দামও সারা বছর ওঠানামা করেছে।
ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি তেল, সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও বেড়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াতসহ প্রতিটি খাতেই খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করেছে বছরের তিন–চতুর্থাংশ সময়। সেই তুলনায় মানুষের আয় বাড়েনি।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বছরজুড়ে জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষকে হিমশিম খেতে হয়েছে। বাজারের তালিকা কাটছাঁট করে তাঁরা সংসার খরচ সামাল দিয়েছেন। গত কয়েক বছরের মধ্যে এত দীর্ঘ সময় ধরে এ রকম মূল্যস্ফীতি আর দেখা যায়নি। সেলিম রায়হান আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরে এসে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতিতে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জিনিসপত্রের দাম কমাতে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হিসাব পাওয়া গেছে। এই ১১ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তার মানে হলো ২০২২ সালে একজন মানুষের যাবতীয় খরচ যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৪৮ পয়সায়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৪৮ পয়সা। এখন কোনো পরিবারের যদি ২০২২ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার টাকা বাজার খরচ হয়, তাহলে ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮৪৪ টাকায়। প্রতি মাসে খরচ বেড়েছে ২ হাজার ৮৪৪ টাকা।
এটি সারা দেশের গড় হিসাবের চিত্র। মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ গরিব মানুষকে বেশি ভুগিয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ ২০ শতাংশের ওপরে। এর মানে একটি গরিব পরিবারের খরচ এক-পঞ্চমাংশ বেড়ে গেছে। কারও কারও ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি। কারণ, চাল, ডাল, চিনি, আটা-ময়দা, শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম, পেঁয়াজসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। এগুলো কিনতেই স্বল্প আয়ের মানুষের আয়ের সিংহভাগচলে যায়।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগে চাকরি করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। মাসে বেতন পান ৪০ হাজার টাকা। স্ত্রী, দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার। বাসাভাড়া, সংসার খরচ, সন্তানদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচ চালাতে গিয়ে প্রতি মাসেই তাঁকে কিছু ধারদেনা করতে হয়। আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে সংসার খরচ ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এই খরচ সামাল দিতে বাজারের ফর্দে অনেক কাটছাঁট করতে হয়েছে। আগে সপ্তাহে এক দিন মাংস খেতাম। এখন দুই সপ্তাহে একবার খাই।
মূল্যস্ফীতির রেকর্ডের বছর
দেশে ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতিতে দুটি রেকর্ড হয়েছে। একটি সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে, অপরটি খাদ্যের মূল্যস্ফীতিতে। এ বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতির উত্তাপ সবচেয়ে বেশি ছিল। ওই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছে, যা গত ১৩৪ মাস বা ১১ বছর দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের মার্চে ১০ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল সার্বিক মূল্যস্ফীতি।
খাদ্যের মূল্যস্ফীতিও এবার গত এক দশকের মধ্যে রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত আগস্টে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে ওঠে, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
৯ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯%–এর বেশি
জিনিসপত্রের দাম বাড়লে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যায়। তা মূল্যস্ফীতি দিয়ে প্রকাশ করা হয়। দেশে টানা ৯ মাস মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। এটাকে বেশ উদ্বেগজনক বলে মনে করা হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশে ওঠে। পরের মাসে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে উঠে যায়। এরপর আর ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। ৯ শতাংশের ওপরেই ওঠানামা করছে। সর্বশেষ গত নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পেরে উঠছে না মজুরি
আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে মানুষের তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে গত দেড় বছর মূল্যস্ফীতির চেয়ে মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের মে মাস থেকে প্রতি মাসে যত মূল্যস্ফীতি হয়েছে, এর চেয়ে কম হারে মজুরি বেড়েছে। গত বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। ওই মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এরপর মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতিকে আর ধরতে পারেনি। এ বছরের নভেম্বর মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। এর মানে হলো মজুরি যত বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম।
সাপের খেলায় কতটা জিতলেন পরিকল্পনামন্ত্রী
গত আগস্ট মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘সাপের খেলা যে জানে, সে ঠিকই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। মূল্যস্ফীতি ওঠানামা করবে। বাজারের স্বাধীনতা আছে। যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তখন মানুষ একটু চাপে থাকে। তখন অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা কমিয়ে দেয়।’
কিন্তু পরিকল্পনামন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, দক্ষ সাপুড়ের মতো মূল্যস্ফীতি কমানো যায়নি। বছরের শেষেও মূল্যস্ফীতি প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশেই রয়ে গেল।