রিজার্ভের দ্বিগুণ অর্থ পড়ে আছে
চলমান ডলার-সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার এই সময়ে দাতাদের প্রতিশ্রুতির অর্থ ছাড় করাতে পারলে কিছুটা স্বস্তি মিলত।
বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার পাইপলাইনে তথা অলস পড়ে আছে। অর্থাৎ দাতাদের বরাদ্দ করা এই অর্থ এখনো ছাড় হয়নি, যা দেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে)।
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ সক্ষমতার অভাবে বিদেশি সহায়তার অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে না। আবার দাতাদের দিক থেকেও কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অর্থ ছাড় করা যাচ্ছে না। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, অনেক দিন ধরে চলমান ডলার-সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত কমে যাওয়ার এই সময় দাতাদের প্রতিশ্রুতির অর্থ ছাড় করাতে পারলে কিছুটা স্বস্তি মিলত।
বিভিন্ন সময় নানা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য দাতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ অর্থসহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। কিন্তু সব অর্থ ছাড় করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত দাতারা যে পরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার তিন ভাগের এক ভাগও ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
এবার দেখা যাক পাইপলাইনে থাকা বিদেশি অর্থ দিয়ে কী করা যেত। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এর দ্বিগুণ হলো (৫ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা) পাইপলাইনে থাকা বিদেশি সহায়তার পরিমাণ। অর্থাৎ পাইপলাইনে থাকা অর্থ দিয়ে দুই অর্থবছরের জন্য দুটি এডিপি করা যায়। মেট্রোরেল নির্মাণ করতে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সে হিসাবে পাইপলাইনের অর্থ দিয়ে ১৫টি মেট্রোরেল তৈরি করা সম্ভব।
আরও সহজ করে বলা যায়, বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুতের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার। অথচ দাতাদের কাছে পড়ে আছে এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ (৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার)। এ নিয়ে বিশ্লেষকেরা বলেন, বাংলাদেশের অভাব শুধু অর্থ ছাড় করার চেষ্টা ও ইচ্ছায়।
এ রকম অবস্থায় সরকার পাইপলাইনে থাকা বিদেশি প্রতিশ্রুতির অর্থ দ্রুত ছাড় করতে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।
পাইপলাইনে বিদেশি সহায়তার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ডলার-সংকট ও রিজার্ভ পরিস্থিতি—এসব বিবেচনায় ডলারের প্রয়োজন মেটাতে দ্রুত বিদেশি সহায়তা ছাড় করা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এ জন্য সরকার বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। এমন কমিটি এর আগেও হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশি সহায়তা থাকলেও তা নানা কারণে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে যত দিন যাচ্ছে, পাইপলাইন ততই বড় হচ্ছ।
প্রতিশ্রুতি ও ছাড়
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দাতাদেশ ও সংস্থা অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে বাংলাদেশকে মোট ১৮ হাজার ৭৬৪ কোটি ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা বর্তমান বাজারমূল্যে দেশি মুদ্রায় ২০ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার মতো। এর প্রায় ৩২ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ এখনো ব্যবহার করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিদেশি সহায়তা ব্যবহার না করতে না পারার হার ক্রমেই বাড়ছে। ৮ বছর আগে ২০১৬ সালে এই হার ছিল ২৯ শতাংশ।
গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্য ব্যবহার করতে পেরেছে ১২ হাজার ৬৮৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে ১ হাজার ৪২২ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতি বাতিল করেছে দাতা সংস্থা ও দেশগুলো। বাকি ৪ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার এখন পাইপলাইনে পড়ে আছে, যা বাংলাদেশ চাইলে ব্যবহার করতে পারে।
ইআরডির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে যেমন সমস্যা আছে, তেমনি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে দাতাদের নানা শর্ত ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মন্ত্রণালয়গুলো বিদেশি সহায়তার প্রকল্পে কম আগ্রহ দেখান। কয়েক বছর ধরে বিদেশি সহায়তার অর্থ ছাড় কয়েক গুণ বেড়েছে।
পাইপলাইনের অর্ধেক ৩ দাতার কাছে
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী হলো বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান। এই তিন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছেই পড়ে আছে পাইপলাইনের প্রায় অর্ধেক অর্থ, যা পরিমাণে ২ হাজার ১৮২ কোটি ডলার। এর মধ্যে জাপানের কাছে সর্বোচ্চ ৮৪৫ কোটি ডলার পড়ে আছে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবিতে পড়ে রয়েছে যথাক্রমে ৭৬৬ কোটি ও ৫৭১ কোটি ডলার। চীন আর ভারতের কাছ থেকেও বড় অঙ্কের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি সহায়তার ধরনও পাল্টেছে, বদলেছে প্রতিশ্রুতিও। স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক বছর দাতারা যে সাহায্য দিত, তার মধ্যে প্রকল্প সহায়তা ছিল গড়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। বাকি সহায়তা আসত খাদ্য ও পণ্য সাহায্য বাবদ। কয়েক দশকের ব্যবধানে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন বিদেশি সহায়তার প্রায় শতভাগই আসে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। তবে কোভিডের সময় কিছু অনুদান এসেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে নেওয়া ঋণের অর্থ বিদেশি সহায়তার হিসাবে ধরা হয় না। এ ছাড়া বিদেশ থেকে নেওয়া বিমান ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মতো বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ঋণও বিদেশি সহায়তায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
সরকারের যত উদ্যোগ
বিদেশি ঋণের প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন ও বিদেশি সহায়তা ছাড় ত্বরান্বিত করতে ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অর্থ সচিব, ইআরডি সচিব আছেন।
৬ মার্চ কমিটির প্রথম বৈঠক হয়। এতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিদেশি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে সাত ধরনের সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি; প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি; দরপত্রের প্রতিটি ধাপে বাধ্যতামূলকভাবে ঋণদাতার অনুমোদন নেওয়া; প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও দাতাদের মধ্যে কাজের সমন্বয়হীনতা; বারবার প্রকল্প সংশোধন; সম্ভাব্যতা যাচাই ও সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নেওয়া এবং প্রশিক্ষণের অভাবে বিদেশি অর্থ ব্যবহারে কর্মকর্তাদের অনভিজ্ঞতা।
প্রতিশ্রুতির ঋণসহায়তা ছাড়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে ইআরডি সচিবকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছেন পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার।
অন্যদিকে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর পরামর্শ দিয়ে বলেন, পাইপলাইনে থাকা অর্থের একটি অংশ বাজেট সহায়তা হিসেবে স্থানান্তর করে ছাড় করা যেতে পারে। এ ছাড়া বিদেশি সহায়তা ব্যবহার করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, এমন মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য প্রতি মাসে অগ্রগতি প্রতিবেদন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা যায়। পুরো বিষয়টিকে তদারকি ও জবাবদিহির আওতায় আনতে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা উচিত। এ ছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনা করে সব ধরনের সমস্যার সমাধান করে বিদেশি সহায়তার অর্থ দ্রুত ছাড় করতে হবে।