আসল কাজ ছাড়া আর সবই পারেন ভ্যাট কর্মকর্তারা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বিভাগ বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অন্য সব লক্ষ্যই অর্জন করেছে, শুধু পারেনি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ করতে। অথচ এই ভ্যাট আদায়ই হলো এনবিআরের এই শাখাটির মূল কাজ। সেই কাজেই কিনা ভ্যাট বিভাগ পিছিয়ে থাকল বিদায়ী ২০২২–২৩ অর্থবছরে।
ভ্যাট বিভাগের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) বাস্তবায়নের অগ্রগতিবিষয়ক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। সরকারের প্রতিটি দপ্তরকে অর্থবছরের শুরুতেই এপিএ করতে হয়। তাতে ওই অর্থবছরে দপ্তর বা সংস্থাগুলো কী কী কাজ করবে, তা নিয়ে ঊর্ধ্বতন সংস্থা বা বিভাগের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এটা ওই সংস্থার আমলনামার মতো। এতে তাদের এক বছরের কাজের ফিরিস্তি থাকে।
ভ্যাট বিভাগের সঙ্গে ১৯টি বিষয়ে এপিএ করেছে। এ নিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করা হয় রাজস্ব আদায়, প্রশিক্ষণ, নতুন করদাতা, গোয়েন্দা কার্যক্রম, রাজস্ব মামলা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, রিটার্ন দাখিল, ইলেকট্রনিক ফিসকেল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপন—এসব বিষয়ে। এপিএতে লক্ষ্যগুলো অর্জনের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আলোচ্য অর্থবছরে ডলার–সংকটসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতি ছিল। আমদানি পর্যায়েও ভ্যাট আশানুরূপ আসেনি। তবে ভ্যাট বিভাগের নিরীক্ষা কার্যক্রম, জরিপ, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিসহ অন্যান্য কার্যক্রমে বিশেষ প্রচেষ্টানির্ভর কার্যক্রমে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
* লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা, আদায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
* ৫০০টি মামলা করার কথা ছিল, বছরজুড়ে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৯৬৮টি।
* ২০০টি প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষার লক্ষ্য ছিল, করা হয়েছে ৯১৭টি প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের এপিএ বাস্তবায়নের ওপর চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে ভ্যাট বিভাগ। এই অর্থবছরে ভ্যাট বিভাগকে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়। কিন্তু বছর শেষে তারা ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে এপিএ-তে তাদের লক্ষ্যের ৯১ শতাংশ অর্জিত হয়। ভ্যাট আদায় করাই হলো এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের প্রধান কাজ। সেখানে বিভাগটি এপিএর পূরো লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলো।
যেসব খাতে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, সেখান থেকে কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন অভিযোগ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ে ৫০০টি মামলা করার কথা ছিল। এর বিপরীতে ভ্যাট বিভাগ যেন মামলার জোয়ার বইয়ে দিয়েছে। যেমন বছরজুড়ে তারা মামলা করেছে ১ হাজার ৯৬৮টি। সারা বছরে ২২টি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করার কথা ছিল, কিন্তু তারা নিষ্পত্তি করেছে ২৯টি।
জরিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়ার লক্ষ্য ছিল। এর বিপরীতে ৭২ হাজার ৭৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে জরিপ কার্যক্রমের আওতায় ভ্যাট নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যের আড়াই গুণ বেশি নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।
ভ্যাট কর্মকর্তাদের আরেকটি কাজ হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরীক্ষা করা। গত অর্থবছরে ২০০টি প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট বিভাগের নিরীক্ষার আওতায় আনার কথা ছিল। কিন্তু সারা বছরে তারা ৯১৭টি প্রতিষ্ঠানকে নিরীক্ষার আওতায় এনেছে। নিরীক্ষা করে ৫০ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনের কথা ছিল। তবে ভ্যাট কর্মকর্তারা এ ক্ষেত্রে আদায় করেছেন ২ হাজার ১১১ কোটি টাকা।
কয়েক বছর ধরে ভ্যাটের ইএফডি মেশিন বসানো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। গত অর্থবছরে সাড়ে ৯ হাজার ভ্যাট মেশিন বসানোর লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। ভ্যাট কর্মকর্তারা বসিয়েছেন ৯ হাজার ৫৬২টি ভ্যাট মেশিন। এ ছাড়া ভ্যাট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের লক্ষ্যও অর্জিত হয়েছে। সব মিলিয়ে ভ্যাট বিভাগ যা করতে চেয়েছিল পুরো অর্থবছরে, এর সবই হয়েছে; শুধু রাজস্ব আদায় ছাড়া। অথচ রাজস্ব আদায় বাড়ানোই তাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।