সরকারি ঋণ ও সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য দায়ী

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় পরোক্ষভাবে সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনেক বেশি টাকা ঋণ নিয়েছে আওয়ামী সরকার। সে ঋণও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১৩ বছর ৭ মাসের মধ্যে গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি তো আরও বেশি, ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

সরকার পতনের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ‘মূল্যস্ফীতির সাম্প্রতিক গতিধারা এবং খাদ্য সরবরাহ পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি সামনে রেখে গত বুধবার অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সচিবালয়ে বৈঠক করেছেন। এ সময় অর্থসচিবসহ খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্য দপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও গভর্নর আহসান এইচ মনসুর পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনশীল পর্যায়ে নেমে আসবে বলে আশ্বাস দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার অর্থই হচ্ছে নতুন টাকা ছাপানো। সেই টাকা বাজারে এলে টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়। এতে দাম বেড়ে যায় জিনিসপত্রের। তা জেনেও সরকার দফায় দফায় ঋণ নিয়েছে, আর বিদায়ী গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ব্যাংক তা দিয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলতে থাকলে তা স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শুধু তাই নয়, মূল্যস্ফীতি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিতকেও দুর্বল করে দেয়, এ কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ওভারড্রাফট হিসেবে সরকারের নেওয়া ঋণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিষয়টি মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রাখছে। সরকারের এভাবে টাকা ঋণ নেওয়া কমানোর জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

তবে সরকারের ঋণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা কত, সেই তথ্য কিন্তু প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৯৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। দেড় বছর আগেও ওভারড্রাফট সীমা ছয় হাজার কোটি টাকা ছিল। আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হয়ে আসেন ২০২২ সালের ১২ জুলাই। এর ছয় মাসের মাথায় ওভারড্রাফট সীমা এক দফায় বাড়িয়ে ৮ হাজার কোটি টাকা এবং পরে আরেক দফা বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকায় তোলেন তিনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে চাহিদার তুলনায় চাল ও পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি। উৎপাদনের পাশাপাশি আমদানির ফলে গম আর রসুনের মজুতও ভালো। এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। সারের দাম কমে হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। সয়াবিন তেলের দাম দুই বছর আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্য কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। যেমন তারা নীতি সুদহার বৃদ্ধি, নিত্যপণ্য আমদানিতে ঋণপত্রের (এলসি) মার্জিন শিথিল করা, সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন, সারে ভর্তুকি, নিত্যপণ্যের জরুরি আমদানি, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি এবং খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি (ওএমএস) ইত্যাদি চালু রেখেছিল।

দেশে মূল্যস্ফীতি কেন এত বাড়ল, তার আরও কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে অর্থ বিভাগ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, চাল-গম, পেঁয়াজ-রসুনসহ দুধ, মাংস, ডিম ইত্যাদি পণ্য সরবরাহে কোনো কমতি নেই। ফলে বাড়তি চাহিদা তৈরি হওয়ার কারণে এগুলোর দাম বেড়ে যায়নি। আর চালের দাম সামান্য বাড়লেও বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দামই এখন নিম্নমুখী। বাম্পার উৎপাদন হয়েছে বলে চালের মূল্যবৃদ্ধিরও যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। জ্বালানি তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমার কারণে পরিবহন খরচ ও অন্যান্য উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলার যুক্তিও শক্তিশালী নয়।

তবে দুই বছরে (২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত) মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমেছে ২৭ শতাংশ। এ কারণে আমদানি করা পণ্যের ওপর একটা প্রভাব পড়েছে অর্থাৎ আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতির যোগসূত্র থাকার জোরালো সম্ভাবনা আছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্য উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে জিনিসপত্রের দামে ব্যাপক পার্থক্য আছে। আর বিবিএস শুধু খুচরা বাজারের উপাত্তের ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হিসাব করে। বিবিএস যদি উৎপাদন ও পাইকারি পর্যায়ে কাজ করে, তাহলে বিভিন্ন পর্যায়ে একই পণ্যের দামের এত পার্থক্য এবং মূল্যস্ফীতির কারণ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। দামের পার্থক্যের পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির পেছনে বাজারে সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতাকেও দায়ী করেছে অর্থ বিভাগ।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমানোসহ মূল্যস্ফীতি কমানোর যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, আমরা এখন সেগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন দেখতে চাই। আমরা দেখেছি, একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করেছে, অন্যদিকে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিয়েছে। এই সাংঘর্ষিক অবস্থা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণ হয়ে উঠেছে। তবে এখন যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবেন বলে আমি আস্থা রাখি।’