তিন বাজেটের সমান ঋণের বোঝা দেশের মানুষের ঘাড়ে
বাংলাদেশের ঘাড়ে দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এ অঙ্ক গত কয়েক অর্থবছরের প্রায় তিনটি বাজেটের সমান। ঋণের স্থিতির এই হিসাব ২০২৩-২৪ অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তাতে দেখা যাচ্ছে, এক বছরে ঋণের স্থিতি ২ লাখ ১৪ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা বেড়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা ছিল। আর চার বছর আগে তা ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার বছরে ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা সরকারের ঋণসংক্রান্ত ত্রৈমাসিক বুলেটিনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশি-বিদেশি মোট ঋণের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ এই প্রথম ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত জুন শেষে অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকায়। ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত যার পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা।
এদিকে গত বছরের জুন শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকায়, চার বছর আগে যার পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে, চার বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
দেশি–বিদেশি এসব ঋণ সরকারি ও সার্বভৌম নিরাপত্তাপ্রাপ্ত ঋণ হিসেবে পরিচিত। ঋণ নেওয়া, ঋণের সুদ দেওয়া, আসল পরিশোধ করা, আবার ঋণ নেওয়া—বিষয়টি এভাবে চলতে থাকে। স্থিতি হিসেবে উল্লেখ থাকা অর্থ ভবিষ্যতে পরিশোধযোগ্য।
* অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। * বিদেশি ঋণের স্থিতি ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। * এক বছরে দেশি–বিদেশি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা।
বাজেট–ঘাটতি মেটাতে দেশি–বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে প্রতিবছর ঋণ নেয় সরকার। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বিদেশি ঋণ সস্তা, সুদও কম এবং পরিশোধের সময়ও পাওয়া যায় বেশি। সেই তুলনায় দেশি ঋণ সহজে পাওয়া যায়। তাই বিদেশি ঋণের চেয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বেশি নির্ভরশীল ছিল দেশি ঋণের ওপরই।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকার ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাবে দেশি উৎস থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিয়েছে, এখন তার ভার এসে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। গত ১৫ বছরে বিদেশি ঋণের বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে দর-কষাকষি ও বাছবিচারহীনভাবে; যা সরকারের দায়দেনা পরিশোধে চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঋণ-জিডিপির হার ৩৬.৩০%
অর্থ বিভাগের হিসাবে গত ৩০ জুন শেষে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ছিল ৫০ লাখ ৪৮ হাজার ২৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে জিডিপির তুলনায় ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশে। চার বছর আগে এই হার ছিল ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণ-জিডিপির হার ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করে থাকে বলে বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়।
যে দেশে কর-জিডিপি হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং যে দেশে দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, সে দেশের জন্য ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ ঋণ-জিডিপি ঝুঁকিপূর্ণ ও দুশ্চিন্তার কারণ।
জিডিপির তুলনায় অভ্যন্তরীণ ঋণের হার অবশ্য চার বছর ধরেই ২০ শতাংশের বেশি। গত জুন শেষে এ হার দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২১ শতাংশ। আর জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে।
অর্থ বিভাগের বুলেটিনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রকৃত (নিট) ঋণের পরিমাণও উল্লেখ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে প্রকৃত ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ ৭৩ হাজার ১০৮ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণ ৮৩ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংক খাত নেওয়া হয় ৮৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আর সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (জিপিএফ) থেকে নেওয়া হয় ৫ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত খাত ও সঞ্চয়পত্র থেকে এই ঋণ ৩৭ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ঋণাত্মক ছিল।
শিক্ষা বাজেট ছাড়িয়ে সুদ ব্যয়
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণের সুদ বাবদ ১ লাখ ১১ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা গুনতে হয়েছে সরকারকে। সুদের এই অঙ্ক প্রথমবারের মতো শিক্ষা বাজেটকে ছাড়িয়ে গেছে। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের শিক্ষা বাজেটের আকার ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এর আগে ২০২২–২৩ অর্থবছরে ঋণের সুদ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুদ ব্যয় বেড়েছে ১৯ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা বা ১৯ শতাংশ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যে দেশে কর-জিডিপির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং যে দেশে দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, সে দেশের জন্য ৩৬ দশমিক ৩০ শতাংশ ঋণ-জিডিপি ঝুঁকিপূর্ণ ও দুশ্চিন্তার কারণ।
শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, বৈদেশিক ঋণও উচ্চ সুদে নেওয়া হয়েছে—এমন মন্তব্য করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে অথচ আছে সক্ষমতার ঘাটতি। ঋণ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে এবং বিদেশে পাচার হয়েছে এই অর্থ। সরকারকে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকতে হবে এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনতে হবে। কারণ, ঋণের অর্থ পরিশোধের চূড়ান্ত দায় পড়ে জনগণের ঘাড়ে।