স্টার্টআপে বিনিয়োগ কমেছে ৭৪ শতাংশ
২০২২ সালে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ কমে মাত্র ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে, যা ২০২১ সালে ছিল ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
করোনা মহামারি শুরুর পরের বছরই দেশের স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগের স্রোত দেখা যায়। সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিকাশ ঘটতে থাকে স্টার্টআপের। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান তো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অংশই হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তবে করোনার ধাক্কার পরেই এ খাত অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়েছে। এক বছরের ব্যবধানেই বিনিয়োগ কমেছে ৭৪ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চলতি বছরটি স্টার্টআপের জন্য কঠিন হবে এবং ব্যবসায় অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে।
সামনের কয়েক বছর স্টার্টআপগুলোর জন্য কঠিন সময়। তাদের বাস্তববাদী হওয়ার পাশাপাশি ভালো গ্রাহক ধরে রাখা এবং ভালো ব্যবসায়ে নজর বাড়াতে হবে।নির্ঝর রহমান, প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ অ্যাঞ্জেলস
তবে ব্যতিক্রমও আছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পিকাবু গত ডিসেম্বরে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মরিন হোসেন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতিই এখন বড় সমস্যা। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তাতে তাদের কেনাকাটায় পরিবর্তন এসেছে।
পিকাবুর সিইও আরও বলেন, বিনিয়োগকারীরা এখন দোটানায় রয়েছেন। সামনে পরিস্থিতি কী হতে পারে, যে প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হবে তারা কতটা টেকসই হতে পারবে, কোন নীতিতে চলছে, মন্দা পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা ও প্রস্তুতি আছে কি না, এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করছেন তাঁরা। স্টার্টআপগুলোর বেশির ভাগই সেবাভিত্তিক এবং সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে ব্যবসা করছে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজার চাহিদা মাথায় রেখে এগোতে হবে।
দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্স দেশের স্টার্টআপ খাত নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা ১১ জানুয়ারি স্টার্টআপে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ পেয়েছিল, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা ধরে)। ২০২২ সালে এ খাতে বিনিয়োগ ৭৪ শতাংশ কমে ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলারে নেমে যায়। আবার এ বিনিয়োগের ৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার পেয়েছে শপআপ। অন্যদিকে ২০২১ সালে মোট বিনিয়োগের ২৫ কোটি ডলারই পেয়েছিল মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) বিকাশ।
মূল্যস্ফীতিই এখন বড় সমস্যা। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তাতে তাদের কেনাকাটায় পরিবর্তন এসেছে।মরিন হোসেন তালুকদার, সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, পিকাবু।
করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, তখনই রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বাধে। যে কারণে পুরো দুনিয়াই এখন মন্দার মুখে রয়েছে। স্টার্টআপগুলোও বাদ যায়নি। ২০২১ সালে বিশ্বের স্টার্টআপগুলোতে মোট বিনিয়োগ হয়েছিল ৬৩ হাজার কোটি ডলার, যা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ৪৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার।
বর্তমানে গোটা বিশ্ব মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে স্টার্টআপগুলো বিনিয়োগ টানতে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে এশিয়ার স্টার্টআপগুলোর জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়েছে। এর কারণ হিসেবে লাইটক্যাসলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি নানা শর্ত ও ঋণের চাপে আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্টার্টআপ খাত একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। সে হিসেবে বাংলাদেশের জন্য বিনিয়োগ পাওয়া এখন আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
লাইটক্যাসলের প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ এশিয়ার পাঁচটি দেশ—সিঙ্গাপুর, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের বিনিয়োগ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশেই সর্বোচ্চ ৭৪ শতাংশ বিনিয়োগ কমেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানে কমেছে মাত্র ৩ শতাংশ।
২০১৮ সাল থেকে দেশের স্টার্টআপগুলোতে বড় ধরনের বিনিয়োগ আসছে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের আধিক্য। গত পাঁচ বছরে করোনা মহামারির বছর ২০২০ সালে স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ কমেছিল অর্ধেক।
২০২২ সালে যেসব বিনিয়োগ এসেছে, তার মাত্র ৮ শতাংশ ছিল দেশি বিনিয়োগকারীদের। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ফিনটেক খ্যাত আর্থিক ও প্রযুক্তি খাতে। গত বছর সেখানেও বিনিয়োগ কমেছে। তবে বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে শিক্ষা, লজিস্টিকস ও মোবিলিটি, ই–কমার্স ও রিটেইল এবং ভ্রমণ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিশ্বের অন্যান্য দেশও চলমান সংকটের শিকার। ১৭ জানুয়ারি ইন্ডিয়া টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৯১টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ হাজারের বেশি কর্মী ছাঁটাই করেছে।
ব্যবসাসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রাঞ্চবেজের এক প্রতিবেদনে উত্তর আমেরিকার স্টার্টআপে বিনিয়োগ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে ৬৩ শতাংশ বিনিয়োগ কমেছে।
দেশের বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্টার্টআপগুলোর অনেকেই নতুন কর্মী নেওয়া কমিয়েছে। তারা এখন বাজার পরিস্থিতি দেখবে। তারা যদি আগামী ছয় মাসের মধ্যে নতুন বিনিয়োগ আনতে না পারে, তাহলে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে নতুন কর্মী না নিয়ে ছাঁটাইয়ের দিকে ঝুঁকবে।
জানতে চাইলে বিডিজবস ও আজকের ডিলের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে কোম্পানিগুলোকে অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিতে হবে। স্টার্টআপগুলোর ব্যয়ের বড় অংশ চলে যায় কর্মীদের বেতন–ভাতায়। এ ছাড়া স্টার্টআপে কিছু কর্মীর বেতন অনেক বেশি থাকে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। কোম্পানিগুলো যতটুকু লোকসানে আছে, তা যেন আর না বাড়ে, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রেও সচেতন হওয়া এবং সঠিক পরিকল্পনা করে প্রতিষ্ঠানকে ধরে রাখায় নজর দেওয়া জরুরি।
স্টার্টআপে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ অ্যাঞ্জেলসের প্রধান নির্বাহী নির্ঝর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সামনের কয়েক বছর স্টার্টআপগুলোর জন্য কঠিন সময়। তাদের বাস্তববাদী হওয়ার পাশাপাশি ভালো গ্রাহক ধরে রাখা এবং ভালো ব্যবসায়ে নজর বাড়াতে হবে।