কতটা অগ্রগতি হলো সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর
বর্তমান সরকারের বড় প্রকল্পগুলো একে একে উদ্বোধনের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের বছরে অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো চালুর মাধ্যমে উন্নয়ন দৃশ্যমান করতে চায় সরকার।
সে জন্য অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা আটটি প্রকল্পের মধ্যে রাজধানীতে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণ করা টানেল যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অক্টোবর মাসের মধ্যে পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চলাচল শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে।
বাকি চারটি প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষে যান চলাচল শুরু হয়েছে। সেতুর ওপর দিয়ে রেলপথে বসানোর কাজও শেষ হয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিটের উৎপাদন শুরু হয়েছে। পায়রা বন্দরের কাজও প্রায় শেষ। রাশিয়ার অর্থায়নে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ নির্বাচনের আগে শেষ হবে না বলে জানা গেছে। এর মানে, আটটি অগ্রাধিকার প্রকল্পের সাতটিই আংশিক বা পুরো চালু হবে। নির্বাচনের বছরে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর যতটুকু শেষ হচ্ছে, ততটুকুই চালু করা হচ্ছে।
প্রকল্পগুলো ফাস্টট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হলেও একটি প্রকল্পও সময়মতো শেষ হয়নি। এতে সময় ও খরচ-দুই বেড়েছে। যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যেত, ততই ভালো হতো। রাজনৈতিক সরকার এসব প্রকল্প শেষ করে ‘রাজনৈতিক সুবিধা’ পেতমোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি
এবার দেখা যাক, অগ্রাধিকার প্রকল্প কোনটি কবে চালু হচ্ছে। আগামী ২০ অক্টোবর মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হচ্ছে। এর আগে গত ডিসেম্বর মাসে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয়েছে। ২৮ অক্টোবর চালু হবে কর্ণফুলী টানেল। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল এবং অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এর বাইরে রাজধানীর আরেকটি বড় প্রকল্প ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত আংশিক চালু হবে ২ সেপ্টেম্বর।
ইতিমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেই প্রতিবেদনে এসব প্রকল্পের অগ্রগতির চিত্র পাওয়া গেছে। সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত আটটি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র তিনটি প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এ প্রকল্পগুলো হলো পদ্মা সেতু, রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর। বাকি প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ৪৪ থেকে ৭৫ শতাংশ।
তবে সরকারের কৌশল হলো, যখন যে প্রকল্পের যতটা কাজ শেষ হয়েছে, ততটুকুই উদ্বোধন করা। নির্বাচনের বছরে আংশিক চালু করে হলেও বড় প্রকল্পগুলো জনগণের কাছে দৃশ্যমান করতে চায় সরকার।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পগুলো ফাস্টট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হলেও একটি প্রকল্পও সময়মতো শেষ হয়নি। এতে সময় ও খরচ-দুই বেড়েছে। যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যেত, ততই ভালো হতো। রাজনৈতিক সরকার এসব প্রকল্প শেষ করে ‘রাজনৈতিক সুবিধা’ পেত। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে হলেও এসব প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। তাতে অন্তত জনগণ উপকৃত হবে, অর্থনৈতিক সুবিধা হবে।’
অগ্রগতি কত
আটটি অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পই সবচেয়ে এগিয়ে আছে। ইতিমধ্যে সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। এখন পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে কমলাপুর থেকে মাওয়া পর্যন্ত রেলসংযোগ নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এটি আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গত জুলাই মাস পর্যন্ত শুধু পদ্মা সেতুর ভৌত কাজ ৯৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ শেষ হয়েছে।
সার্বিকভাবে এ প্রকল্পে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৮ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এটি আর্থিক অগ্রগতি। এই প্রকল্পের মোট খরচ ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে প্রকল্পটি শুরু হয়। আগামী ৩০ জুন প্রকল্পটি শেষ হবে।
২০১২ সালে উত্তরা থেকে মিরপুর ও ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। গত ডিসেম্বর মাসে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হয়েছে। ২০২৪ সালে জুন মাসের মধ্যে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের সম্প্রসারণ প্রকল্পটি শেষ হবে। প্রকল্পে এক দফা খরচ বাড়িয়ে এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। জুলাই পর্যন্ত বাস্তবায়ন হার ৬৮ শতাংশ। আগামী অক্টোবর মাসে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বিনিয়োগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ জুলাই মাস পর্যন্ত প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে একটি ইউনিটে উৎপাদন শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে ১৬ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ তৈরি করতে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শেষ হবে ২০২৪ সালের জুন মাসে। কিন্তু জুলাই পর্যন্ত সাড়ে ৮ বছরে ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে মাওয়া পর্যন্ত কাজ প্রায় শেষ। এখন স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে।
দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এটি শেষ হওয়ার কথা। গত জুলাই মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ৫৮ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।
অন্যদিকে গত আট বছরে মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি ৬৪ শতাংশ। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ হবে।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি দুইবার সংশোধনের পর খরচ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এই পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করতে হবে।
এদিকে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের ভৌত কাজ প্রায় ৮৭ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। এখন স্টেশন নির্মাণের কাজও শেষ পর্যায়ে আছে। তবে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৪৪ শতাংশ। এর মানে, ঠিকাদারকে বিল পরিশোধসহ খরচ হয়েছে বরাদ্দ করা অর্থের মাত্র ৪৪ শতাংশ।