জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশন চালু হচ্ছে না
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে আশা প্রকাশ করেছিলেন, চলতি জুলাই থেকে দেশে সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা চালু করা হবে। অর্থমন্ত্রীর সে আশা আপাতত পূরণ হচ্ছে না। কারণ, জুলাই থেকে তা চালু করতে পারছে না সরকার। জুলাইয়ের বদলে আগস্ট বা সেপ্টেম্বরে তা চালু হতে পারে। আর এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
পেনশন কার্যক্রম চালুর সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে দরকার জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ। কর্তৃপক্ষের একটি কার্যালয়ও দরকার। কিন্তু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ এবং কার্যালয় স্থাপন করতে না পারায় এখন এটির কার্যক্রম জুলাইয়ে শুরু করা যাচ্ছে না।
আপাতত কাজ চালিয়ে নিতে গত বুধবার অর্থ বিভাগের বাজেট ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা উপবিভাগের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী খানকে কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন একই উপবিভাগের আরেক অতিরিক্ত সচিব মো. গোলাম মোস্তফা। আরও সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পেনশন কর্মসূচি চালুর আগে পাঁচটি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) হবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের। সংস্থাগুলো হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, সোনালী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড। এসব এমওইউর খসড়া তৈরি করে রাখা হয়েছে। কবিরুল ইজদানী খানের নেতৃত্বে এখন এমওইউগুলো হবে।
কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া কবিরুল ইজদানী খান গতকাল শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল কাজের অতিরিক্ত হিসেবে এখন মৌলিক কাজগুলো করছি। অন্য সংস্থার সঙ্গে এমওইউ ও অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) করার কাজটি এগিয়ে নিচ্ছি। পেনশন–ব্যবস্থায় নগদ টাকায় কোনো লেনদেন হবে না। সব কাজই হবে অনলাইনে।’ এপিআই হচ্ছে একধরনের সফটওয়্যার, যার মাধ্যমে একটির সঙ্গে একাধিক কম্পিউটার কর্মসূচির যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।
সূত্রগুলো জানায়, পেনশন কর্মসূচি চালুর আগে বিধিমালা জারি হওয়ার কিছু কাজ বাকি আছে এখনো। একটি বিধিমালা মাত্র জারি হয়েছে যার নাম ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সদস্যদের চাকরি বিধিমালা, ২০২৩’। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা, পেনশন কর্মসূচিতে যোগদানের যোগ্যতা ও নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার বিধিমালা এবং জাতীয় পেনশন কর্মসূচি (স্কিম) বিধিমালা নামের আরও তিনটি বিধিমালার প্রজ্ঞাপন হবে শিগগিরই।
আগে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেওয়া হলেও সরকার পরে বয়সের বিষয়টি শিথিল করে ৫০ পার হওয়া ব্যক্তিদেরও পেনশনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ৫০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিরাও ১০ বছর পর্যন্ত চাঁদা দিয়ে আজীবন পেনশন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
প্রবাসী বাংলাদেশি, বেসরকারি চাকরিজীবী, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী এবং অসচ্ছল ব্যক্তি—এ চার শ্রেণির ব্যক্তিদের নিয়ে আপাতত পেনশন কর্মসূচি চালু করা হবে। এর আগে নির্ধারণ করা হবে তাঁদের সংজ্ঞা। মাসিক চাঁদা হতে পারে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা আর সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। তবে কর্মসূচি পরিবর্তন ও চাঁদার পরিমাণ বাড়ানোর সুযোগ থাকবে। প্রবাসী শ্রেণিতে কেউ বিদেশে থাকার সময় পেনশন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ওই প্রবাসী যদি মনে করেন তিনি আর বিদেশে যাবেন না; অর্থাৎ দেশেই থাকবেন, তখন কর্মসূচি পাল্টে যাবে।
আইনে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার পর পেনশনের আওতাভুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। চাঁদা দেওয়ার ১০ বছরের মধ্যে কেউ মারা গেলে জমাকৃত টাকা মুনাফাসহ নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। আর পেনশন পাওয়া অবস্থায় ৭৫ বছরের আগে কেউ মারা গেলে তাঁর নমিনি বাকি সময়ের জন্য পেনশন পাবেন। এ ছাড়া চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ ঋণ হিসেবে নেওয়া যাবে। নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং কর রেয়াতের সুবিধা পাওয়া যাবে। মাসিক পেনশনের অর্থ রাখা হবে আয়করমুক্ত।
সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা চালু করার আগে জাতীয় সংসদে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল পাস হয় গত জানুয়ারিতে। এতে বলা হয়েছে, নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের এতে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে। এ ক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ পেনশন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে সরকার সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা এ পেনশন-ব্যবস্থার আওতাবহির্ভূত থাকবেন।
সংসদে যেসব সমালোচনা হয়েছিল
বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা ওই সময় মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক তখন বলেছিলেন, ‘বিলের কথাগুলো ভালো। তবে এটা ব্যাংকের ডিপিএসের মতো। অর্থমন্ত্রী কথা কম বলেন। অর্থমন্ত্রীর কানে কথা পৌঁছায় কি না, জানা নেই। তাঁর কোনো ফিডব্যাক, উদ্যোগ দেখা যায় না।’
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছিলেন, আপাতদৃষ্টে ভালো হলেও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেভাবে প্রভিডেন্ট করে, এটা তার বাইরের কিছু নয়।
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেছিলেন, চমৎকার উদ্যোগ। কিন্তু এ পেনশন-ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের সাড়া পাওয়া যাবে না। কারণ, সরকারি চাকরিজীবীরা যেভাবে পেনশন পান, তার সঙ্গে অনেক কিছুই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটা অনেকটা ব্যাংকিং প্যাকেজের মতো।