সরকারের আয়–ব্যয়
আয়ে গতি নেই, খরচ শুধু বাড়ছে
কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সংকটকালে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অর্থনীতি বড় হচ্ছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। অর্থনীতির আকারের তুলনায় রাজস্ব আদায়ের অনুপাতে সবচেয়ে পেছনের সারির কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও একটি। সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থের জোগান অপেক্ষাকৃত কম থাকায় দেশি–বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করে বাজেট করতে হয়।
বর্তমানে অর্থনীতি কিছুটা চাপে পড়েছে। ডলার–সংকট ও বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি খরচ বাড়ছে। বাড়ছে ঋণ পরিশোধের খরচও। তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি খাতেও ভর্তুকি বেড়ে যাচ্ছে। খরচ সামাল দিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়নে সাশ্রয়ী হতে হচ্ছে।
যদি দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে আরও বেশি রাজস্ব আদায় করা যেত, তাহলে এখন এডিপির খরচে হাত দিতে হতো না। মূলত শুল্ক-কর আদায়ে তিন দশকে বড় ধরনের সংস্কার না হওয়ায় গতানুগতিকভাবেই রাজস্ব আদায় হচ্ছে। দশকের পর দশক কর ছাড়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
অর্থনীতিতে বর্তমানে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। খরচে সাশ্রয়ী হতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি টেনে ধরা হচ্ছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই, এমন প্রকল্প অনুমোদন না দিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। স্থানীয় উৎস থেকে রাজস্ব আদায় বেশি হলে এখন এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। বিদেশি মুদ্রার মজুত কমে যাওয়ায় বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা; বিদ্যুৎ–সাশ্রয়, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় কম হলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা করতে তেমন বড় সমস্যা হচ্ছে না। কোভিড–পরবর্তী অবস্থা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ—এই দুই পরিস্থিতির মধ্যেও বিদায়ী অর্থবছরে এনবিআরের শুল্ক-কর আদায়ে ১৪ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এটা ঠিক যে রাজস্ব আদায় বেশি হলে এখন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো প্রকল্পে বেশি অর্থ খরচ করা যেত। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হলে বিদেশি বিনিয়োগ বেশি আকৃষ্ট হতো।
রাজস্ব আদায়ে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়
রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতে বিশ্বের তলানির দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত মাত্র ১০ শতাংশ। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল ও লাওস স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ হবে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশ থেকে নেপালের দ্বিগুণ এবং লাওসের দেড় গুণ বেশি। অন্যান্য স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায়ও রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত কম। দেশগুলো হলো শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ভারত, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। এই দেশগুলোর রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত সাড়ে ১১ শতাংশ থেকে প্রায় ২৪ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দেশের মোট রাজস্ব আদায়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ আদায় করে এনবিআর। এনবিআরের আদায় করা কর জিডিপির অনুপাতে ১০ শতাংশের নিচে আছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী তিন বছরে এই হার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
এবার দেখা যাক, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক গড় রাজস্ব-জিডিপি কত। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ইউরো অঞ্চলে ৪৭ শতাংশ; লাতিন আমেরিকায় ২৭ শতাংশ; ক্যারিবীয় অঞ্চলে ২৭ শতাংশ; মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলে ২২ দশমিক ২৩ শতাংশ; আফ্রিকার সাব সাহারায় প্রায় ১৭ শতাংশ। এসব অঞ্চলের গড় রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে।
৪৪ শতাংশ আমদানিতে কর নেই
বর্তমানে রপ্তানিকারক, দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, নিত্যপণ্য ও প্রকল্পের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আমদানিতে কর অব্যাহতি দিয়ে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। বছরে কত টাকার কর অব্যাহতি সুবিধা দিতে হয়, তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের এনবিআরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর সব মিলিয়ে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ অর্থের সমপরিমাণ পণ্য আমদানিতে কোনো ধরনের কর আরোপ করা যায়নি। টাকার অঙ্কে ৩ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ক-কর আরোপ করা হয়নি।
জানা গেছে, ওই বছর ১ লাখ ৬১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার পণ্য আনা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনের কর অব্যাহতি সুবিধা ব্যবহার করে। এ ছাড়া শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের বন্ড সুবিধায় বিনা শুল্কে এসেছে ১ লাখ ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার পণ্য। মূলত পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানই কর অব্যাহতির সুবিধা বেশি পায়। বিনা শুল্কে ইপিজেডের প্রতিষ্ঠানগুলো সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকা এবং কূটনৈতিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধায় ৬০০ কোটি টাকার পণ্য এসেছে।
সব মিলিয়ে ওই বছর আমদানিপর্যায়ে ১ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আরও ৫০ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট ও আয়করের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ২০১৯–২০ অর্থবছর শেষে সব মিলিয়ে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছিল। যত কর আদায় হয়, এর চেয়ে বেশি শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়। অবশ্য দেশের উৎপাদন খাত চাঙা রাখতেই এ ধরনের ছাড় দেওয়া হয়।
গত তিন দশকে একমাত্র ভ্যাট আইন ছাড়া আর কোনো বড় সংস্কার হয়নি রাজস্ব খাতে। সীমিত পরিসরে কিছু অটোমেশন হয়েছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণে যথেষ্ট নয়। আগামী তিন বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ৬৬ শতাংশের বেশি বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে এনবিআর। বিদায়ী অর্থবছরে ৩ লাখ ১৭৯ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে সংস্থাটি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের জন্য ৫ লাখ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংস্কার নেই
গত তিন দশকে রাজস্ব খাতে বড় কোনো সংস্কার নেই। এক ভ্যাট আইন চালু করতে গিয়েই নানামুখী চাপে পড়েছিল এনবিআর। শেষ পর্যন্ত দুই বছর পিছিয়ে দিয়ে একাধিক ভ্যাট হার করে ভ্যাট আইন চালু করা হয়। ফলে ভ্যাট তেমন একটা বাড়েনি। এদিকে শুল্ক ও আয়কর—দুটি পৃথক আইন গত কয়েক বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর—এই তিন খাতে বড় কোনো অটোমেশনও হয়নি। এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে ভ্যাট ও আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয়। কর পরিশোধের ব্যবস্থাও সর্বক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় হয়নি। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে মাত্র ২৫ লাখ মানুষ রিটার্ন দেন।
খরচ যেখানে বাড়ছে
ডলার ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তেল আমদানিতে খরচ বাড়ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক পণ্য হিসেবে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি খাতে সরকারের ভর্তুকিও বাড়ছে। বিদায়ী ২০২১–২২ অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। চলতি অর্থবছর তা বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা খরচের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে দেশি–বিদেশি ঋণের সুদের খরচও বাড়ছে। বিদায়ী অর্থবছরে ৬৭ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
বেতন–ভাতার খরচ কমানোর সুযোগ নেই সরকারের। তাই সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ কমাচ্ছে। এই মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প পাস করা হচ্ছে না। বেশ কিছু প্রকল্প ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ মুহূর্তে পাইপলাইনে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সহায়তা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সেখান থেকে ঋণের অর্থ ছাড় করা গেলে সহজেই বিদেশি মুদ্রার সরবরাহ বাড়ত। যা নতুন প্রকল্প নিতেও সহায়তা করত।